দুই বছর পর গত সন্ধ্যায় আমাদের বাগানে আবার ব্রহ্ম কমল ফুটেছে।
শুনেছি, ব্রহ্ম কমল স্বর্গের ফুল। ব্রহ্ম কমল স্বর্গের ফুল হলেও মাঝে মাঝে মর্ত্যেও ফোটে।
স্বর্গে দিন রাতের হিসেব থাকে কি না জানা নেই। কিন্তু মর্ত্যে অর্থাৎ এই পৃথিবী চলে দিন রাতের হিসেব মেনে।
পৃথিবীতে দিনের আলোতেও প্রাণের জন্ম হয়, রাতের আঁধারেও প্রাণের জন্ম হয়। দিনের আলোতে গাছে ফুল ফোটে, রাতের আঁধারেও ফুল ফোটে।
যে ফুল রাতে ফোটে, তাদের মধ্যে সন্ধ্যা মালতী, হাসনাহেনা অন্যতম, সকলেই জানে ওদের নাম।
সন্ধ্যার পর ফোটে আরও একটা ফুল, সন্ধ্যা মালতী অথবা হাসনাহেনার মতো সাধারণ ফুল নয়। ঝোপে ঝাড়ে অথবা বাড়ির আঙিনায় দেখা যায় না। এদের দেখা যায় গাছ বিলাসী মানুষের ঘরের ভেতরে, বাগান বিলাসী গৃহীর ঘরের কোণে সুদৃশ্য ফুলের টবে ফুটতে, সন্ধ্যার পরে রাত গভীরে।
গাছ বিলাসী গৃহী এই গোত্রের ফুলের নাম দিয়েছে নয়, ' নাইট কুইন' অথবা 'নিশি রাণী'!
আমি গাছ বিলাসী বা বাগান বিলাসী নই, তবে গাছ ভালোবাসি, বাড়ির আঙিনায় ফুল ভালোবাসি।
গাছের প্রতি আমার ভালোবাসার কথা দুই একজন গাছ বিলাসী বন্ধুরা জানে। তাদেরই একজন বছর তিন আগে আমাকে একটা ছোটো গাছ দিয়ে বলেছিলো, ঘরে রেখে বড় করতে। একদিন এই গাছে ব্রহ্ম কমল ফুল ফুটবে। স্বর্গের ফুল ফুটবে পৃথিবীর মাটিতে, মানুষের ঘরের ভেতর। স্বর্গের ফুল ফুটবে আমার ঘরে, ভেবেই আমার আনন্দ হয়েছিলো।
পরের বছরই ফুটেছিলো স্বর্গের ফুল ব্রহ্ম কমল, আমার ছোট্টো বাড়ির ছোট্টো ঘরের এক কোণে।
স্বর্গ যদি ঘরে নেমে আসে, তবে কেন সবাই স্বর্গে যেতে চায়?
স্বর্গে তো শুধু সুস্বাদু খাবার, ফুলের বাগান, সোমরস পান, আর অপ্সরাদের নাচ গান। স্বর্গে সুন্দর সবই আছে, শুধু আপনজন কেউ নেই।
স্বর্গে আপনজন থাকবে কি করে! স্বর্গে তো সকলেই পুণ্যবান মানুষ, আলাদা পরিচয় নেই কারো, কেউ কাউকে চিনবে না! বাবা মা স্বামী স্ত্রী সন্তান সকলেই আলাদা মানুষ, কেউ কারো নয়!
কেউ কাউকে চিনবে না জেনেও কেন সবাই স্বর্গে যেতে চায়? একা একা সুখ হয়?
শুয়ে বসে কত খাওয়া যায়! স্বর্গে কী এমন খাবার আছে যা পৃথিবীতে তৈরী হয় না! এত খাবার খেতে হলে পেটে ক্ষিদে থাকতে হবে তো। শুয়ে বসে থাকলে কি ক্ষিদে পায়! তাছাড়া চারদিকে এত খাবার, গাছ ভরা ফল, থালা ভরা সন্দেশ, পোলাও কোর্মা, খাও যত খুশি।
অভাব না থাকলে কি চাহিদা থাকে! এত অমৃতের মাঝে কারোরই ক্ষিদে তৃষ্ণা কিছুই পাওয়ার কথা না!
এত সুখ অল্প দিনেই অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে যে!
সাত দিন পর হুর আর অপ্সরাদের নাচ গান মনে হবে রাস্তার কল পাড়ে বস্তিবাসীর ক্যাচর ক্যাচর ভ্যাজর ভ্যাজর!
এর চেয়ে এই পৃথিবীতেই আত্মীয় বন্ধু সকলে মিলে মিশে থাকা, সাধারণ ডাল ভাত মাছ খাওয়া, পৃথিবীর রূপ রস গন্ধে আকুল হওয়া কি অনেক বেশি সুখের নয়! যার একটু সাহায্য প্রয়োজন, তাকে সাহায্য করার মধ্যেই কত সুখ লুকিয়ে থাকে!
অদেখা অজানা অচেনা স্বর্গের আশায় চেনা জগতের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে লাভ কি?
স্বর্গ স্বর্গ করে করে জীবনটাই সুন্দরভাবে উপভোগ করা হয়ে ওঠে না!
আমরা কেউই তো জানি না, স্বর্গ কোথায়! স্বর্গ বলে আলাদা কোনো ভুবন আছে কিনা!
আসলে আমরা তো মনের সকল চাওয়া আর না পাওয়াগুলো জড়ো করে নিজ নিজ সুবিধামত স্বর্গ আঁকি, স্বর্গের আঙিনা, নৃত্যবালা এঁকে নাম দেই অপ্সরা অথবা হুরপরী, সোমরসের নাম দেই শরাবন তহুরা অথবা অমৃত সুধা। সবই আমাদের সুন্দর কল্পনা।
কিন্তু স্বর্গের দেখা তো মিলবে মৃত্যুর পরে।আমরা যেমনি কেউ একসাথে জন্মাই না, একসাথে তো মারাও যাই না।
কাজেই একা একা স্বর্গে গিয়ে যে আনন্দ ফুর্তি করবো, কাউকে তো দেখাতেও পারবো না।
খারাপ থাকা যেমনি অন্যকে দেখানো যায় না, ভালো থাকাও তো অন্যকে না দেখানো পর্যন্ত সুখ পাওয়া যায় না!
কল্পনাতেই যদি স্বর্গ খুঁজি, তবে কেন বেঁচে থেকেই পৃথিবীর মাটিতে স্বর্গ রচনা করি না! একা একা নয়, পৃথিবীর স্বর্গে সবাই মিলে থাকবো। একের সুখ অপরে দেখবে, অপরের সুখ আমি দেখবো। সবার সুখে সবাই মিলে সুখে থাকবো।
পৃথিবীতে স্বর্গ রচনা করা তো অসম্ভব নয়! স্বর্গের ফুল ব্রহ্মকমল যদি আমাদের ছোট্ট বাড়ির ছোটো বাগানেই ফোটে, চাইলে আমরা আমাদের চারপাশেই স্বর্গ তৈরি করতে পারি!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন