আসলে বিয়ের পর আমার স্বাস্থ্য এতোটা'ই বেড়ে গিয়েছে যে, সংসারের চেয়ে আমার নিজের বোঝাটাই এখন সবচেয়ে বেশি মনে হয়।
মূলত প্রেম করে বিয়েটা করেছিলাম। বিয়ের আগে দিব্যি নিভির পিছনে (আপনাদের ভাবি আর কি) ঘুরে বেড়াতাম। দুনিয়ায় যত লেভেলের লুচুমি আছে সবটা একসাথে করে নিভিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিলাম। আর তারপর দেখতে দেখতে সময়ের পরিক্রমায় বিয়ে।
তো বলতে গেলে, রোজগারও এখন বেশ ভালোই করি আবার সংসারটাও আমার ঠিকঠাক; তবে সমস্যাটা শুধু আমার স্বাস্থ্য। যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যাধিক হারে বাড়তে থাকে এই বিয়ের পর পর'ই।
শুরুতে অবশ্য বিষয়টা তো আরও খুব বিব্রতকর ছিলো। যেমন, পাশের বাসার ভাই-ভাবি, রিক্সাওয়ালা আসাদ, চা-ওয়ালা বাচ্চু এমনকি অফিসের কলিগ সবাই খুব মজার চোখেই যে আমার এই স্বাস্থ্যগত বিষয়টা নিতো; তা আমি খুব বুঝতে পারতাম। কারণ, চলা-ফেরা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমার প্রায় অনেক সমস্যাই হতো।
তবে এগুলো বিষয়ে অতোটা মাথা না ঘামলেও; মাথাসহ পুরো শরীর ঘামতো আমার তখন, যখন আমি আমার বউয়ের পাশে দাড়াতাম। যা দেখে আমাদের কোনোমতে'ই মনে হতো না যে আমরা স্বামী-স্ত্রী। উল্টো মনে হতো....নাউজুবিল্লাহ।
মাঝে মধ্যে আড়িপেতেই শুনতে পেতাম, নিভিকে পাশের ফ্লাটের ভাবি"রা নানান ধরনের কটাক্য করে বলেই চলেছে; যেমন,
*ভাবি ভাইকে কি এমন খাওয়ান,
*ভাবি ভাইকে জিমে পাঠান,
*ভাবি আমার হাজবেন্ড দেখছেন কতো ফিট,
*ভাবি আপনার স্বামী মনে হয় খুব ভোজনপ্রিয়,
*ভাবি আপনাকে কোলে তুলতে পারে!
*ভাবি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারে!
*ভাবি বিছানায় জায়গা হয়!
ইত্যাদি আরও অনেক কিছু;
তাদের এই জাতীয় কথা বার্তা যতটা না ছিলো কটাক্যের, তার চেয়ে বেশি ছিলো অপমানের। যা আমার বউয়ের কেমন লাগতো আমি জানি না; তবে এগুলো আমার শরীরে একদম কাঁটার মতো বিধঁতো।
একদিন, এক অফিসের কলিগের বিবাহ বার্ষিকীর দাওয়াত পেলাম। তো যথারীতি জামাই-বউ আমরা সেখানে সন্ধ্যাবেলা উপস্থিত। তবে অনুষ্ঠানে ঢুকতেই আমার সিনিয়র স্যার সজোরে বলে উঠলেন,
"এসেছেন আমাদের কুম্ভকর্ণ,
সবাই নিজেদের খাবার নিজ দায়িত্বে রাখুন"।
তার এই কথাটা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। বুঝতে পারছিলাম, মূলত আমাকে হাসির পাত্র বানিয়েই তারা খুব মজা পাচ্ছে। তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসা ছাড়া, আর কোনো রাস্তাই আমার খোলা ছিলো না।
হঠাৎ পাশটাতে খেয়াল করলাম, নিভি পিছন ফিরে আমাকে রেখেই জোরে হাটঁতে শুরু করে দিয়েছে। সেটা দেখে অনুষ্ঠানের লোকজন আরও বেশি মজা পেয়ে আরও জোরে অট্টহাসিতে মেতে উঠেছে। আমি আবার কিছুদূর নিভির পিছনে ছুটে আর পারলাম না, হাপিঁয়ে গিয়েছি। আর নিভি'ও ততক্ষণে একটি রিক্সা নিয়ে আমাকে ফেলেই বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে।
তো চরম পর্যায়ের অপমান আর হতাশ হয়ে তখন আর আমি নিজের গাড়িতে চড়ে বসলাম না। তখন রাস্তার সোডিয়াম আলোর নিচ দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি; আসলেই আমি খুব অপরাধী, অপরাধী আমার এই স্বাস্থ্য নিয়ে, আমি আসলেই ভীষণ অপরাধী আমি এখনও বেঁচে আছি বলে!
নিজের লজ্জাবোধ না হয় মহাকাশে পাঠিয়ে দিয়েছি,তাই বলে নিজের প্রিয় মানুষটারও আজ বেহাল অবস্থা করে ছাড়লাম। তার তো মান সম্মান আজ কিছুই বাকি রইলো না...
রাম্তায় হাটঁতে হাটঁতে এইসব আকডুম বাকডুম ভাবতে ভাবতে কখন যে এক কবরস্থানের দিকে চলে এসেছি, নিজেও বুঝতে পারি নি। ভাবলাম যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, আমার এতো ওজন আর কাউকে কষ্ট করে কাঁধে চড়িয়ে বয়ে নিয়ে আসতে হবে না, আমি নিজেই এখানে চলে এসেছি। তো বসে পড়লাম কবরস্থানের গেটের বাইরেই; আজ রাতে আর বাড়ি ফিরবো না বলেও ঠিক করলাম।
তাছাড়াও সিদ্ধান্ত একদম নিয়েই ফেলেছি যে, যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি আমাকে মরতে হবে; যেন ফজরের আযানের পরপরই আমার মোটা স্বাস্থ্যের শরীরের জানাযা, দাফন-কার্য সবকিছু পুরোপুরি কমপ্লিট হয়ে যায়...ফলে বেশি লোক জানা জানি হওয়ার আগেই ঝামেলা একদম চুকে যাবে।
এদিকে খোদার কি লীলাখেলা; মরার উপায়গুলো চিন্তা চিন্তা করতে করতেই, হঠাৎ কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম,তা নিজে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার চারপাশে পুলিশ আর কিছু লোকজন জড়োসড়ো হয়ে আছে। ভাবছিলাম হয়তো মারা গিয়েছি আর পুলিশ আমার মৃত্যুর ইনভেস্টিগেশন করতে এখানে এসেছেন।
তো পতিত আত্মার ফিলিংস নিয়ে মাত্রই দাফনের টাইম জিজ্ঞেস করাতে গোঁফদাড়িযুক্ত দারোগা বেশ ধমকের সুরেই বলে উঠলো,
"ধূর মিয়া কিসের দাফন!কি করছিলেন টা'কি সারারাত এখানে... আর এমন স্বাস্থ্য বানিয়েছেন, আপনাকে গাড়িতে তোলাও আমাদের সম্ভব হয়নি... থানায় চলুন জলদি, আপনার স্ত্রী আপনার নামে জিডি-মামলা ঠুকেছে"।
পুলিশ ব্যাটার এই জিডির কথা শুনে মাথায় একদম আকাশ ভেঙে পড়লো। নিভি মানে, আমার বউ নাকি আমার নামে জিডি করেছে। আবার গতকাল নিভি যে পরিমাণ অপমান হয়েছে আমার জন্য, মানহানির মামলা ঠুকে দেয়নি তো! আর যদি তা হয়, তাহলে মোটা হওয়া না বরং বেঁচে থাকাটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
অতঃপর পুলিশ ব্যাটা আমাকে নিয়ে সোজা থানায় চলে এলো। সেই পুলিশ ব্যাটা তার চেয়ার ভাঙার ভয়ে আমাকে মেঝেতেই লেপ্টে বসতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠলো, "আপনার স্ত্রীকে খবর দেওয়া হয়েছে, সে আসতেছে"।
আর এই কথাটা শুনে কেমন যে লজ্জায় মাথাটা আপনাআপনি আমার নিচু হয়ে গেলো।
হঠাৎ নিভির উপস্থিতি টের পেলাম। বেচারি এসেই আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাদঁতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ, সে নাকি আমাকে কাল সারারাত খুঁজেছে। পরে আর কোনো উপায় না পেয়ে, নিভি পুলিশের আশ্রয় নিয়েছে। অবশ্য মানহানির নয়, নিখোজঁ হওয়ার ডাইরী করেছে।
মোটকথা,
পুলিশ ব্যাটাও মজা নিয়েছে আমার সাথে।
নিভিকে তারপর গতরাতে অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেই নিভি বললো,সে নাকি এইসব শুনতে শুনতে তার একদম কান পাকিয়ে ফেলেছে। তাই সে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমাদের সেকেন্ড হানিমুনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
তা এবার নাকি সে আমার সাথে নেপাল যাবে হানিমুনে, তাই তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে যায় ব্যাগ পত্র গোছানোর জন্য। আর আমাকে সাথে নিলে নাকি তার অনেক সময় লাগতো, তাই সে নিজেই একা চলে গিয়েছিলো।
এতসব কাহিণী শুনে মনে ততক্ষনে লাড্ডু ফুটে গেছে আমার। মনে দুসরা লাড্ডু ফুটলো তখন; যখন নিভি বললো, আমি মোটা তাতে কি হয়েছে...আমাদের ভালোবাসাটা নাকি তার চেয়েও বেশি মোটা আর পুরু। তারপর মনে তিসরা লাড্ডু ফুটলো তখন...যখন শুনলাম আমরা নাকি আজ বিকেল তিনটার ফ্লাইটে সরাসরি নেপাল শুসসস করে উড়ে যাচ্ছি।
মোটকথা, অন দ্য ওয়ে টু মাই সেকেন্ড হানিমুন।
- আসলে ঠিক এমনটাই হয়। যারা মনে থেকে কাউকে ভালোবাসে, তাদের সম্পর্কে এইসব শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার কখনও কোনো বাধার সৃষ্টি করে না।
যে আপনাকে ভালোবাসে, সে আপনি মোটা হন বা চিকন, ফর্সা হন বা কালো, খাটো হন কিংবা লম্বা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই সে ঠিক আপনাকে ভালোবেসেই যাবে।
ওই যে ফিল্মের ডায়লোগ আছে না,
"ভালোবাসা ভালোবাসে শুধুই তাকে,
ভালোবাসা ভালোবেসে ভালোবাসা ভালো............"ইয়ে মানে মনে নাই আর কি"!
তো যাই হোক,
ভালো রাখুন আর ভালোবাসতে থাকুন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন