দিনটি ছিলো ২০১২ সালের অক্টোবরের পাঁচ বা ছয় তারিখ। ইউটেরাসে ক্যান্সার আক্রান্ত আমার মা ঢাকা শহরের নামী-দামী এক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
দুই দিন আগেই মা'কে শেষবারের মত দেখতে আমেরিকা থেকে এসে আমি সরাসরি হাসপাতালে চলে যাই।
সেখানেই পর পর পাঁচ দিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আই সি ইউ ইউনিটের ওয়েইটিং রুমে অন্য রোগীর প্রিয়জনদের সাথে বসে থেকেছি।
এই চার পাঁচদিনে আমার কত রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে, কত নতুন মানুষ দেখা হয়েছে, কত জনের সাথে পরিচয়!
একদিন দেখলাম, ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান নীরব দর্শনার্থীদের অনেকেই নড়ে চড়ে উঠলো, সবাই একই দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসুকভাবে কিছু দেখছে। আমি ওদিকে তাকাতেই দেখি, ছয় সাত জন সুবেশ নরনারীর সাথে গায়ক শুভ্র দেব এগিয়ে আসছে। আমার চোখের সামনে দিয়েই ওরা আইসিইউর মেইন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।
সিলেটের প্রবীণ শিল্পী বিজিতলাল দাস গুরুতর অসুস্থ, আইসিইউতে ভর্তি আছেন। তাঁকেই দেখতে এসেছে সেদিনের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী শুভ্র দেব।
দশ মিনিট পরেই শুভ্র দেব বেরিয়ে এলো, একই সুবেশ নর নারী পরিবেষ্টিত হয়ে। এবার নতুন সদস্য হিসেবে কয়েকজন ডাক্তারকেও শুভ্র দেবের পাশে দেখলাম।
ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান দর্শনার্থীরা ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে গেছে আইসিইউতে থাকা তাদের আপনজনের কথা। এমন তারকা শিল্পী চোখের সামনে, শিল্পীর সাথে একটু কথা বলার বিরল সুযোগ, তাদের চোখে মুখে আগ্রহ উপচে পড়ছিল। স্মার্ট ফোনের চল তখনও শুরু হয়নি, নইলে নির্ঘাত শুভ্র দেবের সাথে সেলফি তোলার জন্য লাইন লেগে যেতো।
অই পাঁচ দিনেই বুঝেছি, হাসপাতাল মানেই অসুস্থতা, মৃত্যু, বিষাদ, মন খারাপ, কান্না, হতাশা, জলের মত টাকা খরচ নয়! হাসপাতালের সাথে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিজয় আনন্দও আছে।
হাসি-কান্নার দুই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দুই একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একদিন একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে যা ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রতিটি মানুষকে মুহূর্তের জন্য হলেও কৌতুকমিশ্রিত আনন্দ দিয়েছে।
ঘটনাটি ছিলো এরকমঃ
চৌদ্দ তলা হাসপাতাল বিল্ডিং এর পঞ্চম তলায় আই সি ইউ বিভাগ। আমি আর আমার কাজিন পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয় তলায় যাওয়ার জন্য লিফটের অপেক্ষায় ছিলাম।
গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে লিফট উঠে আসছে, পঞ্চম তলায় এসে দরজা খুলতেই দুই তিনজন লিফটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, এরপর আমি ভাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। লিফটের ভেতর অনেক মানুষ, পরবর্তী স্টেশনে নামার জন্য ট্রেনের কামরা, বাসের দরজায় যেমন অনেকেই ভীড় করে থাকে, ঠিক তেমন ভীড় লিফটের দরজার মুখে।
যেহেতু লিফট উপরের দিকে যাচ্ছে, তৃতীয় তলায় নামতে দেরি হবে, তাই আমি সবার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি।
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন খুবই অমায়িক কন্ঠে (পুরুষ) কেউ বললো,, 'আমাকে একটু মাফ করুন"!
প্রথমে বুঝতে পারিনি কে কার কাছে মাফ চাইছে। দ্বিতীয়বার 'আমাকে মাফ করুন' শুনতেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিকে একটু নড়েচড়ে উঠতে দেখলাম।
দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এবার সেই পুরুষ বিনয়ী কন্ঠ একটু অসহিষ্ণু কন্ঠে বললো, "আমাকে মাফ করুন, কথাটি কত বার বললাম। একটা কথা বললে সেটা ভালো করে বুঝার চেষ্টা করতে হয়"।
বলেই আমার সামনে দাঁড়ানো যুবককে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক লিফট থেকে বেরিয়ে আইসিইউ ইউনিটে নেমে গেলো, সাথে সাথে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো়।
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতভম্ব, আমিও। হতভম্ব অথবা হতচকিত হওয়ার কারণ বের করতে দেরি হয়নি।
'এক্সকিউজ মি' না বলে ভদ্রলোক পর পর তিনবার শুদ্ধ বাংলায় "আমাকে মাফ করুন' বলেছেন।
দিন রাত 'এক্সকিউজ মি' এক্সকিউজ মি বলে এবং শুনে অভ্যস্ত ভদ্রজনদের পক্ষে' এক্সকিউজ মি' কথাটি মাতৃভাষায় তর্জমা করলে ' আমাকে মাফ করুন' হয়, লিফটের ভেতর ভীড়ে গাদাগাদি অবস্থায় অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
এরপর শুরু হয়ে গেলো বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী খিক খিক হাসি, বিদ্রুপ, নানা রকম টীকা টিপ্পনী।
আমি নিজেও একটু সময়ের জন্য মায়ের অসুখের কথা ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম একটু আগেই মা'কে আইসিইউতে কষ্ট পেতে দেখে বাইরে এসে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি।
আমাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে এক ভদ্রলোক আমাকে ছোটো বোন ডেকে উনার পাশের চেয়ারে বসিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন।
সব ব্যথা ভুলে আমি বেশ শব্দ করেই হেসে ফেললাম। এটাও বললাম, "ভাগ্যিস আমি ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়াইনি, বাঙালি হলেই কি, লিফট থেকে নামার সময় কেউ যদি বলে, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি তো বুঝতেই পারতাম না ক্ষমা চাইছে কেন!"
আমার কথায় সামনের যুবকটি বলল, ' আমিও বুঝতে পারিনি উনি কার কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। এক্সকিউজ মি বললেই তো আমি উনাকে বের হওয়ার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতাম।"
লিফটের ভেতরে রুগী দেখতে আসা বিষণ্ণ স্বজনদের একজন মন্তব্য করল,
"হাসপাতালে আসছে নাটক করতে। শুদ্ধ ভাষা ফুটাইতে আসছে লিফটের ভিতরে। লিফটের ভিতরে দম ফালাইতে পারি না, উনি বাংলা কাব্য শুনাইতে আসছে, যত্তসব।"।
আরেকজন বললো, " এক্সকিউজ মি' বললেই চলতো, তা না করে ভদ্রলোক উলটা তেজ দেখিয়ে গেলো"।
সবচে মজার মন্তব্যটি করে ফেললো এক মহিলা, " মাফ করেন, মাফ করেন কওনের কি আছে, আমরা কি ভিক্ষুক নাকি? ভিক্ষুকরে মাইনষে মাফ করতে কয়। ব্যাডা এইখানে আসছে নক্সা দেখাইতে"।
ততক্ষণে লিফটটি চৌদ্দ তলা পর্যন্ত গিয়ে তারপর নীচে নামতে শুরু করেছে। এর মধ্যে দুই একজন যার যার ফ্লোরে নামার সময় বললো, " দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন"! সাথে সাথে হাসাহাসি।
আমি কাজিনকে নিয়ে তৃতীয় তলায় নেমে গেলাম। জানি না সেই ভদ্রলোকের 'আমাকে মাফ করুন' ডায়ালগটি নিয়ে আরও কিছুক্ষণ সকলের মাঝে হাসি ঠাট্টা হয়েছিলো কিনা।
[[ **** আমি তখন বিভিন্ন ব্লগে লিখতাম। আমার মা মারা গেলেন অক্টোবারের ৮ তারিখে, অক্টোবারের ১৩ তারিখে অতি বিনয়ের গলায় দড়ি' শিরোনামে এই ঘটনাটির উল্লেখ করে 'প্রিয় ব্লগ' এবং 'বিডিনিউজ২৪' ব্লগে পোস্ট করেছিলাম।
বিডিনিউজ২৪ ব্লগে বেশ কিছু পাঠক কমেন্ট লিখেছিলেন যা ছিলো লেখার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত।
শুধুমাত্র একজন পাঠক লিখেছিলেন,
[দিদি, আপনার বর্তমান কঠিন শোকের সময়েও লেখায় রসবোধ হারাননি দেখে বিস্মিত হয়েছি, স্বস্তিও পেয়েছি। ]
সেই পাঠকের নাম মনে নেই কিন্তু তাঁর কমেন্টটি আমার খুব ভালো লেগেছে বলেই স্মৃতিকোষে রয়ে গেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন