‘বোরহানিতে কেউ এত ঝাল দেয়! একটা মানুষও ঠিকমতো খেতে পারেনি।’
গলা খাকারি দিলেন জামিল সাহেব। তবে তিনি যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন, সেই তুহিন কোন কথা বলল না। সে এক হাতে চোখ ঢেকে আরেক হাতে একটা পাতাবাহার গাছ ধরে শরীরের টাল সামলানোর চেষ্টা করছে। এই মাত্র জামিল সাহেব তাকে চড় মেরেছেন। চড়টা লেগেছে তুহিনের চোখ এবং কপালের মাঝামাঝি। যার কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। জামিল সাহেব অবশ্য গাল বরাবরই চড় দিয়েছিলেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে বড়লোকরা গালে চড় মারতে পছন্দ করে। তুহিন সরে যাবার চেষ্টা করতেই তার চোখের উপর এসে পড়লো শক্ত হাতটা।
‘তোকে কে কাজে নিয়েছে? এর আগে বিয়ে বাড়ির রান্না করেছিস তুই?’ এবারে কথাগুলো নীচু স্বরেই বললেন তিনি। জামিল সাহেব চাচ্ছেন না বিয়ে বাড়ির কোন অতিথি তার উচ্চকণ্ঠ শুনে ফেলুক। বিয়ে বাড়িতে এরকম উচ্চস্বরে কথা বলাটা কোন দিক দিয়েই শোভনীয় নয়।
তুহিন চোখ ডলতে ডলতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কোন রকমে বলল, ‘ময়না ভাই আইতে কইছে আমারে। আমি আগেও বিয়া বাড়িতে রানছি।’ তার এক চোখ লাল হয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে জামিল সাহেব কিছুটা নরম হলেন। চড়টা একটু জোরেই লেগে গেছে।
এমন সময় ময়না বাবুর্চি ছুটে এলো সেখানে।
‘কী হইছে স্যার? কোন সমস্যা?’ উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চাইলো ময়না বাবুর্চি।
জামিল সাহেব বললেন, ‘তুমি কী সব লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছো আজকাল। রান্নার কিছুই হয়নি।’
ময়না বাবুর্চি এত বড় অপবাদ বিনা বাক্যে মেনে নিতে পারল না। তার চোখে মুখে বিস্ময়। সে শহরের নামকরা বাবুর্চি। রান্না ভালো হয়নি এটা না বলে রাতের বেলা সূর্য উঠেছে বললেও হয়তো সে এতটা অবাক হতো না। সে স্পষ্ট কন্ঠে বলে ফেলল, ‘এইডা আপনি কী কন স্যার। আমার রান্না খারাপ হইছে-গত দশ বছরে এমন কথা শুনি নাই। তাছাড়া মেহমানরা তো সবাই মজা কইরা খাইতাছে দেখলাম।’
ময়নার কথা শুনে জামিল সাহেবের রাগটা ফিরে এলো। এখন তার মনে হচ্ছে ঐ অল্প বয়সী ছোকরাকে চড় না দিয়ে তার ওস্তাদ অর্থাৎ ময়নার গালেই চড় দেয়া উচিত ছিল।
‘বোরহানিতে এত ঝাল কেন হলো? এক ঢোক খাওয়ার পরই খাওয়া ছেড়ে উঠে এসেছি আমি।’ রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে বললেন তিনি।
‘স্যার, আমরা তো কমই দিছিলাম ঝাল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে আপা মনি আইসা কইলো ঝাল একটু বেশি দিতে। তার ভার্সিটির বন্ধুরা না-কি ঝাল পছন্দ করে। সেই জন্য দিছি। আমাগো দোষ কী এইহানে!’
‘তাই বলে এত ঝাল!’
‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। আমি নিজে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম সবাই বলছে ঝাল ঠিকই ছিলো।’
জামিল সাহেব বুঝতে পারলেন তার রাগ পড়ে গেছে। রাগ দেখানোর মতো কোন যুক্তি তার মাথায় এলো না। তিনি বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলেন না। তিনি একবার তুহিনের দিকে তাকালেন। ছেলেটার চোখ দিয়ে পানি পড়া বন্ধ হচ্ছে না। চোখে চোখ পড়া মাত্রই তুহিন আর সেখানে দাঁড়ালো না। চোখের পানি লুকানোর জন্যই হয়তো সে বাবুর্চি খানার তাঁবু ছেড়ে বিয়ে বাড়ির গেইটের দিকে চলে গেল।
তুহিন চলে যাওয়ার পর জামিল সাহেব বললেন, ‘অবশ্য আমি একটু ঝাল কম খাই। তাছাড়া আমার জিভে বোধহয় কোন সমস্যা হয়েছে। ঝাল একদমই সহ্য হচ্ছে না ইদানীং।’
ময়না কোন কথা বলল না। সে বিজয়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। সে বুক ভরা অহংকার নিয়েই বলতে পারে তার রান্না কখনো খারাপ হয় না।
‘যাই হোক, রাগের মাথায় ওকে আমি চড় মেরে দিয়েছি। কারণ শুনলাম ও-ই ছিল বোরহানির দায়িত্বে।’ জামিল সাহেব বললেন।
এই কথা শোনা মাত্রই ময়না বাবুর্চির মন খারাপ হয়ে গেল। সে বিস্ময় ভাব গোপন না করেই বলল, ‘আপনি ওরে মারছেন! কাজটা একদম ভালো করেন নাই স্যার।’
‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। আমি সচারাচর কারো গায়ে হাত তুলি না। কিন্তু হঠাৎ খুব রাগ উঠে গেল। আমি ওকে বোরহানির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার জন্য এসে দেখি- ও ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমাকে দেখেও সে ফোন রাখেনি। এতে রাগটা আরও বেড়ে যায়।’
‘আপনি ওর গায়ে হাত তুললেন! তাও আবার আজকের এই দিনে!’
‘হ্যাঁ, বিয়ে বাড়িতে গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হয়নি।’
‘আপনি তো জানেন না। আজকে তুহিনেরও বিয়া। ও কাজে আসতে চায় নাই। আমি জোর করে বললাম চল- বড় লোক বাড়ির বিয়া ভালো টাকা পাবি। নতুন জীবনে যাইতাছোস। টাকা পয়সার দরকার আছে। আমার খুবই খারাপ লাগতাছে স্যার। আমি ওরে জোর কইরা না আনলে হয়তো বিয়ার দিন চড় খাওয়া লাগতো না ওর।’
‘কী বলছো এসব! আজ ওরও বিয়ে।’
‘হ স্যার। এখান থেকে বের হয়েই ও বিয়া করতে যাইবো কমলাপুর। ও যে ফোনে কথা কইতেছিল, সম্ভবত ওর হবু বউয়ের সাথেই।’
‘নাহ নাহ, কাজটা আমি একদমই ঠিক করি নি।’ জামিল সাহেবকে বেশ অবাক দেখালো। তিনি মানিব্যাগ থেকে দুটো লম্বা নোট বের করে ময়না বাবুর্চির হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা ওকে বকশিস দিও। আর আমি আসলে কী বলবো বুঝতে পারছি না। দোষ তোমার। আজ ওর বিয়ে ওকে কাজে আনা ঠিক হয়নি তোমার।’
বেশ অপ্রস্তুত হয়েই বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেল জামিল সাহেব। তিনি যে অনুতপ্ত এটা খুব ভালো ভাবেই বোঝা গেল।
তুহিন গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা দেখছিলো। বাড়ির সামনে বিশাল এক গেইট বানানো হয়েছে। বড় রাস্তার মোড়ে বানানো হয়েছে আরেকটা গেইট। পুরো রাস্তা জুড়ে নানা রঙের বাতি জ্বলছে। পুরো বাড়ি মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। এক পাশের বাতি জ্বেলে ওঠার সাথে সাথেই আরেক পাশের বাতি নিভে যাচ্ছে। মূল বাড়ির পাশাপাশি বাইরের গাছগুলোর পাতার ফাঁকে ফাঁকেও বাতি বসানো হয়েছে। এমন ভাবেই গাছগুলো বাতি দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে- হঠাৎ দেখলে মনে হবে আলোর চাদর গায়ে দিয়েছে গাছগুলো। তুহিন মুগ্ধ হয়ে বিয়ে বাড়ি দেখে। বিয়ে বাড়ি তো এমনই হওয়া উচিত – মনে মনে ভাবে সে। শুধু সমস্যা হচ্ছে তার চোখ দিয়ে এখনো পানি ঝরছে। নিয়ন বাতির আলো ঝাপসা দেখাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল তুহিনের। তাদের উঠোনে একটা একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। আর ঘরের এক পাশের বেড়ায় মরিচ বাতি। তুহিনের ছোট বোনের বয়স তেরো। তেরো বছরের অভিজ্ঞতায় সে জানে বিয়ে বাড়িতে আলোকসজ্জ্বার ব্যবস্থা করতে হয়। সেজন্য বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে সে কোথ থেকে যেন কিছু মরিচ বাতি জোগাড় করে ঘরের এক পাশের বেড়ায় সেগুলো লাগিয়ে দিয়েছে। তার খুব ইচ্ছা ছিল পুরো বাড়িই মরিচ বাতি লাগাবে- কিন্তু সে ব্যবস্থা করতে পারেনি।
‘তোরে কইছিলাম আজ কামে যাওয়ার দরকার নাই। বিয়ার দিন আবার কাজ কিরে হারামজাদা!' তুহিন উঠানে পা রাখতেই বলল ছগির উদ্দিন। তিনি তুহিনের বড় মামা। সবাই তৈরি হয়ে তার জন্য বসে আছে। দশ-বারো জনের ছোট্ট বরযাত্রী দল। এদের সবাই পুরুষ। কোন মেয়েকে বরযাত্রীতে নেয়া হবে না।
তুহিন কোন কথা না বলে সরাসরি কলের পাড়ে চলে গেল। টিউবওয়েল চেপে দ্রুত গোসল করতে লাগলো সে। সারা শরীরে মশলার গন্ধ লেগে আছে। সে ভালো করে সাবান ঘষতে লাগলো । আজ রাতে তার বাসর হবে। নতুন বউ নিশ্চয়ই স্বামীর শরীরে মশলার গন্ধ পছন্দ করবে না।
গোসল শেষে তুহিন একটা পাঞ্জাবি পরলো। ঢোলা পাঞ্জাবিতে তাকে একটুও মানাচ্ছিলো না। তবু তুহিনের মনে হলো তাকে সুন্দর লাগছে। আজ তার জীবনের বিশেষ একটা দিন। সাথে তেরো জন সদস্য নিয়ে তুহিন কমলাপুরের দিকে রওনা হলো। অল্প দূরত্বের রাস্তা বলে পায়ে হেঁটেই রওনা হলো তারা। যদিও বরযাত্রী দলটা খুবই ছোট ছিল, কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যেতো বিশাল একটা চাঁদ তাদের সাথে সাথে রওনা হয়েছে। গায়ের লোম দেখা যায় এমন তীব্র জোছনা মাড়িয়ে তুহিন রওনা হয়েছে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দিকে।
#পরিশিষ্টঃ
তুহিন যখন বাসর রাতে ঢুকল তখন প্রায় মধ্যরাত। তুহিন ধীর ভঙ্গিতে খাটে গিয়ে বসলো। নতুন বউয়ের লজ্জা পাওয়ার কথা। অথচ সে কোন রকম লজ্জা, সঙ্কোচ না করেই বলল, ‘আপনের চোখে কী হইছে কালা দাগ কেন? কী হইছে?’
তুহিন থমথমে মুখে বলল, ‘কিছু না এমনি।’
‘সত্যি কইরা কন এই দাগ কিসের?’
‘এইটা আমার জন্মদাগ।’ লাজুক ভঙ্গিতে বলল তুহিন।
‘উঁহু দেইখা কিন্তু মনে হইতাছে না এইটা জন্ম দাগ। মনে হইতাছে কোনহানে ব্যথা পাইছেন।'
‘না বউ এটা জন্মদাগ। এটা হইলো গরীবের জন্মদাগ।’
নতুন বউ তুহিনের কথা বুঝলো কি-না বোঝা গেল না। সে আলতো করে তুহিনের চোখে হাত রাখলো। তুহিনের চোখের ব্যথা সেরে গিয়েছিলো। এবারে কোন কারণ ছাড়াই তার চোখ ভিজতে শুরু করলো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন