বিয়ের দিন আমার বান্ধবীসহ সব ভাবীদের এক কথা ছিল, "বর তো মাশাআল্লাহ বেশ নাদুসনুদুস,ভার সইতে পারবি তো?তোর জন্য খুব টেনশন হচ্ছে রে মেহুল!"
তাঁদের এই কথাটা আমার কাঁটা গাঁয়ে নুনের ছিটার চেয়ে কম ছিল না,বরং লবণ আর ধানী লঙ্কার সংমিশ্রণে হাই ডোজ ছিল বটে!এমনিতেই বাবার ভয়ে চুপচাপ বিয়েতে বসেছি,তাঁর উপর সকলের টিপ্পনী।সত্যি বলতে দুঃখ কম রাগ হচ্ছিল বেশি।
আমি জুয়াইরিয়া আফসার মেহুল,ম্যাথম্যাটিক্সে অনার্স করছি।অবশ্য পড়ছি বললে ভুল হবে,পড়তাম।দেড় বছরের উপর ভার্সিটি বন্ধ,আমি যে স্টুডেন্ট সেই পরিচয় ভুলে গেছি বহু আগে।মা এই ক'দিনে আমাকে পাক্কা কাজের বুয়া জরিনা বানিয়ে ফেলেছেন।সংসারের সব দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে তিনি আরামসে সিরিয়ালে মগ্ন থাকেন অথবা পাশের বাসার আন্টির সাথে আড্ডা দেন।বাবা আমার সংসারী রূপ দেখে এতোই প্রসন্ন হয়েছেন যে চটজলদি বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইলেন! বাবাকে আমরা দুই বোন যমের মতো ভয় পাই,তাঁর উপর টু শব্দ করার জো নেই আমাদের।মাকে কত তেল মালিশ করলাম এখুনি বিয়ে না দিতে,সে তো পাত্তাই দিলো না।বরং বললো,এই লকডাউনে তোর চেয়ে ছোট মেয়েরা বাচ্চার মা হয়ে গেছে।তুই তো সেই তুলনায় যথেষ্ট বড়!
মনের দুঃখে বনে যাবো সেই সুযোগ ও রইলো না।তাই নিয়তি ভেবে চুপচাপ বিয়ের পিড়িতে বসলাম।কে জানতো কোরিয়ান নায়ক তো দূর বাংলাদেশের নায়ক ও মিলবে না?জুটলো কি না শেষে গোপাল ভাঁড়ের আপগ্রেড ভার্সন!
হলুদের দিন নান্নানের কাছে বসে অনেকক্ষণ কান্না করলাম।তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,মোটা মানুষদের মন অনেক ভালো হয়।এমন করে কাঁদিস না নানুভাই,বাপ মা কোনোদিন সন্তানের খারাপ চায়না।আল্লাহর হুকুম এখানে ছিল হয়তো।
মনকে বুঝ দিয়ে মনের মধ্যে বিশাল পাথর নিয়ে বসে ছিলাম বৌ সেজে।সবার নানারকম টিটকারিতে সেই পাথর গলে পানি হয়ে যাচ্ছে।
তিন অক্ষরের কবুল আর রেজিস্ট্রিতে একটা সাইন করে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।বিদায়ের সময় কারো সঙ্গে একটা কথাও বললাম না কাঁদলাম ও না,নিজে নিজে গাড়িতে উঠে মুখ ফিরিয়ে বসলাম।মনে মনে পণ করলাম এই বাড়িতে মরে গেলেও আর আসবোনা।খুব বোঝা হয়ে গেছিলাম কি না, সেই বোঝা আর বইতে হবেনা তাঁদের!
""তুমি ঠিক আছ মেহুল?""
তাকিয়ে দেখি আমার বর মানে আরহাম ফাহিম আমার দিকে গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে।
আমি গলা ঠিক করে বললাম ,হু ঠিক আছি।
আরহাম অবাকের স্বরে বললো,আমি এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখলাম যে বিদায়ের সময় একটুও কাঁদলো না!তুমি কি ভেতরে ভেতরে কাঁদছো?না মানে একটা স্টেটাস দেখেছিলাম "চোখের পানি তো সবাই দেখে কিন্তু ভেতরের রক্তঝরা কান্না কেউ দেখেনা" তুমি কি সেই টাইপ কাঁদুনে??
আমি তাঁর কথা শুনে বেশ বিরক্ত হলাম।কিসব বলে এই লোক!কাটকাট গলায় বললাম,শুনুন সবাই কে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে তা তো না!আর এইসব লাইন মুখস্থ রাখেন কিভাবে?সারাক্ষণ ফেসবুকে থাকেন নাকি??
সে হো হো করে হাসতে লাগলো যেন আমি কোনো ফানি জোক্স বলেছি।
সাদামাটা একটা চারতলা বিল্ডিং এর সামনে গাড়ি থামলো।তিনতলার মাঝারি সাইজের একটা ফ্লাটে সবাই আমাদের বরণ করে নিলো।আমি মনে মনে কারণ খুঁজতে লাগলাম কি বিশেষত্ব ছিল এই ছেলের মাঝে।ঢাকায় এমন ফ্লাটে ভাড়া থাকা বড় ব্যাপার না।আমাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো,দাদাসাহেবের অঢেল সম্পত্তির সিংহভাগই বাবার অর্থাৎ উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের দু'বোনের।আমিতো ভেবেছিলাম আমাদের চেয়ে ধনী ছেলে দেখেই বাবা এখানে বিয়ে দিলো।কিন্তু তাঁদের দেখে মোটেও বিত্তশালী মনে হলোনা।আরহামের দুই বোন মাঈশা আর আরজু আমাকে তাঁদের ভাইয়ের রুমে নিয়ে বসালো।গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো সিম্পল একটা বাসরঘর!আসবাব বলতে বেড,টেবিল চেয়ার,আলমারি আর ছোট্ট একটা ড্রেসিং টেবিল।বেড সাইডে ছোট টি টেবিল টাইপ বুক সেল্ফ।সেখানে আরহামের ছবি আর ক্লক রাখা।খুব সাধারণ হলেও ঘরটা বেশ স্নিগ্ধ!কেমন জানি আপন আপন ফিল হলো।
হঠাৎ রিপা ভাবীর কথা মনে পড়তেই ঘাম ছুটে গেল আমার।এখুনি নিশ্চয়ই লোকটা এসে স্বামীর অধিকার চাইবে!তাঁর ঐ বিশাল শরীরটার নীচে আমার মতো নিরীহ মেয়েটা পিষে মরবে ওহ নো!!
ভয়ে ভয়ে দোআ ইউনুস পড়ে যাচ্ছি এমন সময় আরহাম ভেতরে আসলো,নানুর শেখানো অনুযায়ী মুখে সালাম দিলাম।সে সুন্দর করে সালামের জবাব দিয়ে বললো,উযু আছে?দু রাকাত নামায পড়তে হবে।
--উযু করতে হবে।গয়না সব খুলে ফেলবো?
--তুমি এতোক্ষণ এসব পড়ে থাকবেন জানলে তো আরো আগেই বলে যেতাম এসব খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও।কিভাবে যে এসব পড়ে আছো দেখেই তো আমার গরম লাগছে!
আমি চুড়ি-গয়না সব খুলে ওয়াশরুমে ঢুকলাম এক ঘন্টা ধরে ঘষে মেকাপ তুললাম।এতো কিছু মাখছে আল্লাহ রে আল্লাহ!!
সবশেষে সুতি শাড়ি পড়ে উযু করে বের হলাম।বের হয়ে দেখি সে খাটের কিনারায় বসে বসে ঘুমাচ্ছে।দেখে খুব মায়া লাগলো আহারে বেচারা!
সবকিছু বেলকনীতে মেলে দিয়ে তাঁকে ডেকে দুই রাকাত নামায পড়ে নিলাম।সে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মোনাজাতে দোআ চাইলো।তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললো,আল্লাহ তোমাকে সুখী করুন।
জানিনা কেন তাঁর এই কাজটা আমার বেশ ভালো লাগলো।তারপর সে একটা চেক ধরিয়ে দিয়ে বললো,আমার সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমোহর তিনলক্ষ টাকা ধার্য করা হয়েছিল,এটা তার উসুল।তোমার যা ইচ্ছে এটা দিয়ে তাই করতে পারো।
কম টাকা কাবিন হয়েছিল বলে খালামণির উক্তিটা মনে পড়লো তখন,"এতো কম টাকা কাবিন আজকাল ফকিররাও ধরেনা।দেখো গিয়ে ছেলের মনে শয়তানি আছে কিনা।কম টাকা হইলে তালাক দিতে সময় লাগেনা।কাবিন যতো বেশি হইবো পোলা ততো ভয়ে থাকবো"
আরহামের উদ্দেশ্য বেশ স্পষ্ট।অনেক ধনীরাও বিয়ের রাতে মোহরানা আদায় করেনা,দশ বিশ লাখ টাকা আদায় করা সহজ কথা না,তাই আজীবন সেটা বাকিই থেকে যায়।তারচেয়ে বরং সামর্থ্য অনুযায়ী ধরে আদায় করে ফেলাটাই বরকতময়।
আরহাম বলল,তুমি কি রাগ হয়েছ এতো কম টাকা কাবিন বলে?
আমি বললাম,না রাগ হবো কেন?
--তোমার খিদে পেয়েছে?আমার তো ভীষণ খিদে পেয়েছে।যাই দেখি কিছু আছে কিনা,
আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়েছে বড়জোর দুই ঘন্টা হবে।এরমধ্যে খিদে পেয়ে গেল!
সে দুই প্লেট খাবার এনে বললো,তুমি তো কিছুই খেলেনা তখন,তাই তোমার জন্য ও নিয়ে এলাম।লজ্জা পেওনা এখন,খেয়ে নাও।খাওয়ার বেলা লজ্জা পেলে লস।এই পৃথিবীর সব যুদ্ধ বিগ্রহ এই খাওয়ার জন্য।
আমি প্লেট হাতে নিয়ে মনে মনে বললাম "হ ভাই ঠিক কইছেন আপনারে দেখলেই বুঝা যায় "
খেয়েদেয়ে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো।আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
বৌভাতের পর বাবা আমাদের নিতে চাইলেন।আমি মুখের উপর বলেছি ও বাড়িতে যাবোনা।বাবা রেগে কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু শাশুড়ি আম্মু বললেন,বেয়াই সাহেব বৌমা কয়দিন পর যাবে,আমাদের আত্মীয়স্বজনরাও আছে তাঁরা তো সবসময় আসবেনা।তাই নতুন বৌ এখানেই থাকুক।
বাবা আর কোনো কথা বললেন না।তিনি চলে যাওয়ার পর মা বললেন,বৌমা তুমি কি কোনো কারণে রাগ করে আছো বাবার উপর?
আমি কিছু বললাম না।উনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,জানোতো মা রাগ কেবল ধ্বংস করে,এই জীবনটা রাগ করে কাটানোর জন্য খুব ছোট।বাবার উপর রাগ করে থাকতে নেই।
রুমে বসে ছোটবোনকে খুব মিস করছিলাম।এমন সময় আরজু এসে বলল,ভাবী দেখো ভাইয়া কাকে নিয়ে এসেছে।
তাকিয়ে দেখি আমার ছোট বোন জেরিন দাঁড়ানো।ওকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।
জেরিন বললো,আপু তুই কেমন নিষ্ঠুর একবারো ফোন করলিনা,বৌভাতে সবাই এলাম দেখাও করলিনা।ভাইয়া গিয়ে না আনলে তোকে আর দেখাই হতোনা আমার।
আরহাম বললো,এখন এখানে দাঁড়িয়েই কি বুড়িগঙ্গা বানাবে?ভেতরে গিয়ে বসো।
রাতে আরজু,মাইশা,জেরিন, আমি মিলে অনেক গল্প করলাম।কিন্তু রাত যতো ঘনিয়ে এলো আমার মনে ততো ভয় বাড়ছে।কাল রাত তো পার করেছি আজ কিভাবে,,,
অনেক ভেবে ঠিক করলাম আজ আরহামকে বলবো স্লিম না হওয়া পর্যন্ত সে যেন আমার থেকে কোনো কিছু আশা না করে!কিন্তু পরে যদি সে বলে মোহরানা শোধ করেছি,ধর্ম মেনে বিয়ে করেছি তবে অধিকার থেকে বঞ্চিত হবো কেন?তখন কি বলবো?এমন নানা চিন্তায় রুমে গিয়ে ঘুমানোর ভান ধরে শুয়ে পড়লাম।ঘুমিয়ে গেলে নিশ্চয়ই জাগাবেনা।
আরহাম রুমে এসে বেশকিছুক্ষণ টেবিলে কিসব লেখালেখি করলো,তারপর ডিম লাইট অন করে বেডে এসে বসলো।আমার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
এভাবে একেকদিন একেক বাহানা দিয়ে আমার দিন কাঁটতে লাগলো।আরহাম ও নিজে একবারো কাছে টানলোনা।আমি নিশ্চিন্ত মনে সবার সাথে মিলেমিশে সংসার নামক যুদ্ধটায় অংশগ্রহণ করলাম।
ছুটিরদিন দুপুরে রান্না শেষ করে সবে গোসল সেড়ে বেলকনীতে কাপড় মেলছি এমন সময় আরহাম এসে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।ঘাড়ে গলায় নাক ঘষে চুমুতে ভরিয়ে ফেলছিল।তাঁর প্রথম স্পর্শে আমি যতোটা শিহরিত ছিলাম তাঁর চেয়ে বেশি ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।সারা শরীরে কাঁপুনী ধরে গেল,আমি রেগে এক ঝাটকা দিয়ে দূরে সরে গেলাম।
সে করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো,আমি ঝাঁঝালো গলায় বললাম,এমন অসভ্যতার মানে কি?এভাবে পারমিশন ছাড়া হুট করে এসে হামলে পড়া কেমন ভদ্রতা?
আরহাম মুখ কালো করে বললো,স্যরি আসলে আমারই ভুল ছিল।তোমাকে এভাবে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি,স্যরি।
আমার রাগ তাতেও কমলোনা আমি চিৎকার করে বললাম,নেক্সট টাইম আপনি আমার আশেপাশেও ঘেষবেন না।আপনাকে আমার জাস্ট অসহ্য লাগে।আমি আপনার এই বিশাল শরীরটাকে ভয় পাই,আমি আপনাকে ভয় পাই।I can't Carry it.I'm not prepared for this.Please pardon me..
আমার কথায় আরহামের চোখে পানি চলে এলো,সে আর একমুহূর্ত বিলম্ব না করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।আমি বেলকনীর ফ্লোরে বসে হাঁটুর ভাঁজে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলাম।সব হয়েছে বাবার জন্য,আমি তাঁকে কোনোদিন ক্ষমা করবোনা।সে কেন ভাবলোনা তাঁর মেয়ে এমন ছেলেকে কিভাবে সামলে চলবে!
সেই রাতে আরহাম ঘরে ফিরলো না,ফোন করে জানিয়ে দিল বন্ধুর বাসায় আছে রাতে ফিরবেনা।
মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো কিছু হয়েছে কিনা।আমি উত্তর দিলাম না, পুরো রাত কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম।পরদিন আরহাম এলো বিকেলের দিকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেড়িয়ে গেল,মাইশা দৌড়ে এসে বললো,ভাবী ভাইয়া ছয় মাসের জন্য সিলেট চলে যাচ্ছে।তুমি কিছু
বলছোনা কেন?মা বলেছে তোমাকে নিতে ,ভাইয়া তো রাজীই হলোনা।
--সিলেট কেন যাচ্ছে?কি কাজ ওখানে?
--অফিসের কাজে যাচ্ছে বললো।তোমাকে কিছু বলেনি?
আমি হেসে বললাম,আমাকে কেউ কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনা মাইশা!বাবাও মনে করেনি তোমার ভাইয়াও মনে করে নি
মাইশা কি বুঝলো জানিনা তবে মা ঠিকই বুঝলো আমাদের মাঝের সমস্যাটা।কিন্তু কোনো কথাই শোনালোনা জিজ্ঞাসাও করলোনা কিছু।কলেজ খুলতেই বাবা বললো,বৌমা আমরা চাই তুমি স্টাডি কন্টিনিউ করো।ফাহিম ও ফোনে তাই বলেছে,তোমার জন্য টাকা পাঠিয়েছে।প্রয়োজনে খরচ করো,আরো লাগলে বলতে সংকোচ করোনা।তুমি আমার বাকি দুই মেয়ের মতোই।
রেগুলার ক্লাস আর সংসারের টুকটাক কাজ করে আমার দিন কাঁটতে লাগলো চরম ব্যস্ততায়।এর মাঝে মা অনেকবার এসেছিলেন আমাকে নিতে কিন্তু আমি যাইনি।সবাই এসে আমাকে দেখে যায়,তবে কারো সঙ্গেই আগের মতো প্রাণ খুলে হাসিমুখে কথা বলিনা।একদিকে যেমন নিজ পরিবারের সবার উপর রাগ ছিল তেমনই মায়া জন্মাচ্ছিল আরহামের পরিবারের সকলের প্রতি।আমি না পারছিলাম সব ছেড়ে চলে যেতে না পারছিলাম এই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে।কতোটা যন্ত্রণা আর দ্বিধায় আমার দিন কাটছিল বলার শব্দ নেই।আরহামকে মিস করিনা তা নয়,তাঁর ছোট ছোট কেয়ারগুলো মিস করি।সে কাছে না থাকলেও স্বামীর কর্তব্য পালন করে গেছে,রোজ আমার খবর নিয়েছে।যদিও আমাকে একদিনও কল করেনি,আমিও করিনি।কৌশলে আরজু অথবা মাঈশা থেকে তাঁর খবর শুনতাম।
একদিন রাতে ডাইনিং রুমে পানি নিতে এসে দেখলাম মা বাবার রুমে দরজা খোলা,মা কাঁদছেন আর বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছে।কৌতুহলবশত আমি নিরবে দাঁড়িয়ে রইলাম,মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,ছেলেটা নিজের কি হাল করেছে দেখছো?ডায়েট করার নামে খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে,জিমে ভর্তি হয়েছে।সারাদিন পরিশ্রম করে আবার জিম ও করে।ওগো এভাবে চললে ও তো অসুস্থ হয়ে যাবে,,
বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,এখন অনেকেই জিম করে রোগা হচ্ছে,সমস্যা নেই তো।ওর ওজনটা কমলে ওরই ভালো হবে।জেদ হোক আর যাই হোক কাজটা তো খারাপ হচ্ছেনা।আমরা আদর করে যা করাতে পারিনি এখন সে নিজ থেকে তা করছে যখন কষ্ট পাচ্ছ কেন?
--মেহুল বোধহয় ওকে এজন্য পছন্দ করেনি,তাই ও চলে গেছে!আমাদের ছেলে যে কি না একটা রাত ও আমাদের ছেড়ে থাকেনি সে এতগুলি দিন সিলেটে পড়ে আছে।
--আহা এতো কেঁদোনা তো।সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি রুমে এসে বসে রইলাম।আরহামের ছবির ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে পুরো ঘরে চোখ বুলালাম,কার ঘরে পড়ে আছি আমি!যে কি না আমার জন্য এই বাসা ছেড়ে চলে গেছে?সত্যি বলতে অনুতাপের আগুনে খুব জ্বলছিলাম।একবার মনে হচ্ছিল তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাই,সে যেমন তেমনি মেনে নিবে এমন এক মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হোক।কিন্তু সমাজে ডিভোর্সিদের অবস্থান ভেবে সাহসে কুলালোনা।তাছাড়া বাবা আমাকে ঘরে ঢুকতে দিবেনা।নানারকম দুশ্চিন্তায় পুরো রাত বসেই কাটিয়ে দিলাম।পরদিন মাকে বললাম আমি সিলেট যাবো, টিকেটের ব্যবস্থা করতে।বাবা একা কিছুতেই ছাড়বেন না আমি কেঁদেকেটে বাধ্য করলাম রাজী হতে।তিনি চেয়েছিলেন সঙ্গে আসতে আমি নিলাম না,সিলেট স্টেশনে পৌঁছানোর আগে আমি আরহামকে কল করলাম।ভেবেছিলাম কয়েকবার রিং হবার পর রিসিভ হবে কিন্তু সে প্রথম রিং এই রিসিভ করলো যেন ফোন হাতে নিয়ে কলের অপেক্ষা করছিল!বহুদিন পর তাঁর গলা শুনে আমার কেমন অনুভব হচ্ছিল বলে বোঝাতে পারবোনা।কোনোরকমে বলেছি স্টেশনে আসুন।
সে আগের মতোই প্রাণোচ্ছল গলায় বললো,আমি আধ ঘন্টা ধরে স্টেশনেই বসে আছি।কোনো অসুবিধা হয়নিতো?সাবধানে এসো।
আমি বুঝলাম নিশ্চয়ই মাঈশা ফোন করে বলে দিয়েছে।
স্টেশনে নেমে দাঁড়াতেই আরহামকে দেখলাম!পেটের ভুঁড়িটা বেশ কমেছে,ক্লান্ত মুখখানায় তখনো হাসির ঝিলিক।সে হেসে বললো,তোমার সাহসের জবাব নেই ঢাকা থেকে একা একা চলে এলে!
আমি বললাম,বাসায় চলুন।বাসায় যাওয়া যাবে নাকি হোটেল বুক করতে হবে?
--হোটেল বুক করে রেখেছি।একা থাকি বড় বাসা নিয়ে কি করবো।
হোটেলে ঢুকেই আমি শাওয়ার নিলাম।জ্বর যে ভালোভাবে বেড়েছে খুব টের পাচ্ছি।কিন্তু মিটমাট না করা অবধি আমি স্থির হবোনা।আজ হয় সংসার টিকবে নাহয় শেষ।
ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল,আরহাম বেশ মনোযোগ দিয়ে খাবার পরিবেশন করছে।আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম,আপনার প্ল্যান কি?
সে স্বাভাবিক গলায় বললো কিসের প্ল্যান?
---আপনি এখানে চলে এসেছেন আজ পাঁচ মাস।আমি খবর পেয়েছি আপনি এখানেই সেটেল হবার পরিকল্পনা করছেন মানে কি এসবের?
সে হেসে বললো,আরে এই ব্যাপার!আসলে এখানে যে প্রজেক্টে এসেছি তা এতো সাকসেসফুলী হয়েছে যে স্যার চাইলো আমি এখানের সব দায়িত্ব নেই,এমনিতে দু এক দিনের জন্য ঢাকা গিয়ে বেড়িয়ে আসতাম তো,,,,
--আপনার কাছে এরচেয়ে বেটার অপশন আছে কিন্তু।
--কি অপশন?
--আপনি চাইলেই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এমন কাউকে বিয়ে করতে পারেন যে আপনাকে ভালোবাসবে এট লিস্ট আমার মতো অবহেলা করবেনা!অযথা আমার জন্য পরিবারের সবার থেকে দূরে থেকে তাঁদের কষ্ট দিচ্ছেন কেন?
আরহাম হেসে বললো,মেহুল বিয়েটা কি ছেলেখেলা?মন দেওয়া নেওয়া কি এতো সোজা?
তুমি হয়তো আমাকে পছন্দ করোনা ভালোবাসোনা তাই বলে আমি যে তোমায় পছন্দ করিনা তা নয় কিন্তু!ইনফ্যাক্ট তোমাকে ভালোবাসি বলেই ,,,,,,,
জানো স্ত্রীদের দায়িত্ব হচ্ছে স্বামীর মনমতো নিজেকে সুসজ্জিত রাখা।যাতে সে আকর্ষিত হয়।ঠিক তেমনই স্বামীর দায়িত্ব তাঁর স্ত্রীর মনমতো হওয়া।তুমি আমার ওভার ওয়েট নিয়ে ফেডাপ ছিলে,আমি জানি এজন্যই তুমি তোমার ফ্যামিলির উপর রাগ।তোমার মতো মেয়ে আমার চেয়ে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে।হাজবেন্ড হিসেবে আমার মতো কাউকে কোনো মেয়েই চাইবেনা।ভাগ্য তো বদলাতে পারবোনা তাই নিজেকে বদলে নিচ্ছি,দেখো পাঁচ মাসে 20কেজি কমেছে।যদি আল্লাহ চায় এক বছরে নিশ্চয়ই পারফেক্ট শেইপে চলে আসবো।
--তারপর?
--তারপর নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ভয় পাবেনা!আমাকে অসহ্যবোধ করবে না,,
আরহামের কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম।সে দৌড়ে এসে বললো,স্যরি মেহুল আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি।কথাটা ওভাবে বলিনি আসলে।
আমি গা ছেড়ে দিয়ে বললাম,আপনি আমার সঙ্গে কালকেই ঢাকায় ব্যাক করবেন আমি আর কোনো কথা শুনবোনা।
তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই,,,,সকালবেলা জ্ঞান ফিরতেই দেখি আরহাম আমার পাশে বসে আছে।পাশেই বালতি জগ আর রবার ক্লথ রাখা।আমি খুব মন দিয়ে দেখলাম আমার গলুমলু বরটাকে।ঘুমন্ত চেহারাটা কত মায়াময়,হাইটের সাথে ওয়েট মিলে এতোদিন তাঁকে বৃহদাকার মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে এখন যেটুকু আছে পারফেক্ট।এরচেয়ে কম হলে মানাবেনা।সকলের কথায় প্রভাবিত হয়ে ভেতরের মিনিমাম মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে বসেছি।তাঁকে অমানুষের মতো বাহ্যিকভাবে হেয় করেছি।যাই হোক কাউকে বডি শেমিং করা মোটেও উচিত না।টেবিলে রাখা রাতে খাবার সেভাবেই পড়ে আছে লোকটা পুরো রাত না খেয়েই ছিল!
আমি নড়েচড়ে উঠতে সে জেগে বললো,আহা উঠছো কেন কিছু লাগলে আমাকে বলো?
--আপনি সারারাত এভাবে বসে ছিলেন?
--তুমি কেমন মেহুল এতো জ্বর ছিল তোমার গাঁয়ে আমিতো বুঝতেই পারিনি!এই জ্বর গাঁয়ে নিয়ে তুমি এতোটা জার্নি করলে?
তারপর কপালে হাত রেখে বললো ,যাক জ্বর এখন নেই।কি ভয় পেয়েছিলাম জানো?
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে বললাম,আপনার ওয়েট কত ছিল?
সে মাথা নতো করে বললো,105।
--এখন 85?
--হু।
--কষ্ট করে আর পাঁচ কেজি কমালেই চলবে।
আর সেটা ঢাকায় থেকেই করা যাবে।আবার ভাববেন না আপনাকে ছোট করে ওয়েটকে প্রায়োরটি দিচ্ছি।আপনার সুস্থতার জন্যই বললাম পারফেক্ট থাকুন,দীর্ঘদিন বাঁচুন।এখন চটজলদি অফিসে ফোন করে বলেদিন আজ ছুটি।আমরা এখন জাফলং যাবো।
আরহাম হতভম্ব হয়ে বললো,জাফলং কেন?
--শুধু জাফলং না,শাহজালাল শাহপরাণ মাজার,বিছানাকান্দি,চা বাগানসহ এখানে যা যা আছে সবখানে ঘুরবো।সাত রঙের চাও খাবো।
--কিন্তু আমার অফিস,,,
-- কোনো কিন্তু না আমার বহুদিনের শখ ছিল সিলেট আসার,এখন সুযোগ যখন পেয়েছি হানিমুন সেড়েই ফেলি কি বলেন?
--মেহুল জ্বরে কি তোমার মাথা গেছে?কি সব প্রলাপ বকছো?ভয় করছে না এখন?
আমি আরহামের গলা জড়িয়ে গাঢ় গলায় বললাম,উহু একটুও ভয় করছেনা।যে ছেলেটা শুধুমাত্র আমার জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় হভি কন্ট্রোল করে ওয়েট কমাতে পারে,তাঁকে ভালো না বাসলে অনেক বড় অন্যায় হয়ে যাবে যে!আমি আপনাকে ভালোবাসি।এ ক'দিন আপনাকে কত মিস করেছি জানেন?
--মেহুল বিনিময়ে ভালোবেসোনা প্লিজ!ভালোবাসা কোনোকিছুর বিনিময়ে হয়না।তোমাকে জোর করে মেনে ,,,
পুরো কথা শেষ হবার আগেই আমি তাঁর অধরে অধর ডুবিয়ে দমবন্ধকরা স্বর্গীয় রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।যেখানে কোনো কিছুই অসুন্দর নয়,সবকিছুই রংধনুর মতো রঙিন রঙিন____
আরহাম আমায় কোলে তুলে বললো,অবশেষে আমার প্রেমের ফুল ফুটেছে,তুমি নিজেই ধরা দিলে তবে,,,,, তারপর কপালে গভীর করে চুমু এঁকে বললো, অনেক ভালোবাসি বৌ!
আমি লজ্জায় তাঁর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম।
#গল্পটা_আমাদের
(ভালোবাসাটা যেমন বাহ্যিকভাবে বিচার করে হয়না,তেমনই অবহেলায় ও হয়না।দুপক্ষের ই উচিত জীবনসঙ্গীর জন্য নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা।বাইরের পার্টি বা অকেশনে সকলকে দেখানোর জন্য যতোটা ঝকঝকে সাজি তার 50% কেবল নিজের মানুষটার জন্য এফোর্ট করা কি খুব কঠিন?অন্য মানুষকে আকর্ষণ না করে কেবল নিজের মানুষটাকেই আকর্ষণ করি?
বেশি বড় হয়ে গেল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন