কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের মহানুভবতা : ত্রিপুরা পল্লীতে ৫০ বছর পেলো ‘ককবরক’ মাতৃভাষার স্কুল

 

শরিফুল আলম চৌধুরী, কুমিল্লা উত্তর ঃ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষা রক্ষার জন্য ভাষার মাসে কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ী এলাকায় ‘ত্রিপুরা পল্লী ককবরক মাতৃভাষা স্কুল’ নির্মাণের কাজ চলতি বছরের গত ২১ ফেব্রুয়ারী শুরু করা হয়েছিলো। এখন এখানে বসবাসরত ত্রিপুরা সম্প্রদায় ৫০ বছর পর তাদের নিজেদের মাতৃভাষার স্কুল পেয়েছে।

গত রবিবার বিকালে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতির নাচে গানে এ স্কুলটি উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগ কুমিল্লার উপ-পরিচালক শওকত ওসমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সদর দক্ষিণ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাবুল, স্থানীয় ২৪ নং ওয়ার্ডের সিটি কাউন্সিলর মো. ফজল খান। সভাপতিত্ব করেন সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিষ ঘোষ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন শালমানপুর ত্রিপুরা উপজাতি কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি সজীব চন্দ্র ত্রিপুরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লালমাই পাহাড়ের শালমানপুর, জামুড়া, বৈষ্ণবমুড়া ও সদরের হাদকপুরে ৯৮টি ত্রিপুরা সম্প্রদায় পরিবারে প্রায় ৪০০ লোক বসবাস করে। কালের বিবর্তনে ত্রিপুরা অধ্যুষিত এই এলাকায় এখন এই সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাদের ভাষা রক্ষার জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কামরুল হাসানের নির্দেশনায় উপজেলা প্রশাসন ‘ত্রিপুরা পল্লী ককবরক মাতৃভাষা স্কুল’ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে (একুশে ফেব্রুয়ারী) স্কুলটির নির্মাণকাজের সূচনা করেন সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশিস ঘোষ। এদিন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা সেখানে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনারও তৈরি করে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।


ককবরক স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মনিন্দ্র চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ‘ককবরক ভাষাটি তিপ্রাকক বা ত্রিপুরি ভাষা নামেও পরিচিত। ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্য এবং বাংলাদেশে বসবাসরত ত্রিপুরি জাতির লোকদের মাতৃভাষা। নতুন প্রজন্মের কাছে এখন এই ভাষার আর অস্তিত্ব নেই। তেমন বইপুস্তকও নেই। তবে খাগড়াছড়ী এলাকায় স্বল্প পরিসরে এই ভাষা নিয়ে গবেষণা চলছে। আমাদের মাতৃভাষা (ককবরক) রক্ষার জন্য এই প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে কৃতজ্ঞ।’

সদর দক্ষিণ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাবলু জানান, ‘ভাষার চর্চা না থাকার কারণে ক্রমেই বিশ্বের অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে ককবরক ভাষাও হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ভাষা রক্ষার জন্য স্কুল নির্মাণে প্রশাসনের উদ্যোগ অনুকরণীয় ও ব্যতিক্রম।’

সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ জানান, ‘ককবরক’ শব্দটি দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত। কক অর্থ ‘ভাষা’ আর বরক অর্থ ‘মানুষ’, বিশেষিত অর্থে ত্রিপুরি জাতির মানুষ; অর্থাৎ ককবরক কথাটির অর্থ ত্রিপুরি মানুষের ভাষা। নতুন প্রজন্মের কাছে ককবরক ভাষাটি যথার্থভাবে পৌঁছে দিতে এবং বিলুপ্তপ্রায় এ ভাষাটিকে রক্ষা করতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় এই স্কুলের নির্মাণকাজ শুরু করে তা আজ উদ্বোধন করা হয়েছে।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, ‘ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা ‘ককবরক’ শেখার লিখিত কোনো বই এ মুহূর্তে নেই। ককবরক ভাষা শেখার বই প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের মাতৃভাষা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। স্কুলের কাজ শেষ, এখন ককবরক ভাষায় বই প্রকাশের ব্যবস্থা করা হবে।’

তবে এখনো জামুড়া, বৈষ্ণবমুড়া, হাদকপুরের শিশুদের নেই মাতৃভাষা নিয়ে লেখাপড়ার ব্যবস্থা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন