কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে প্রায়ই নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। এতে সাধারন মানুষের মনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। বিশেষ করে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হচ্ছে কেন্দ্র।
দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি, কোন্দলে ইন্ধন এবং দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। দলের কেন্দ্র থেকে একাধিকবার সতর্ক করে দেওয়ার পরও যারা এখনো নির্দেশ অমান্য করছেন তাদের সবার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জানতে চাইলে দলের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, কেউ দলীয় শৃঙ্খলা বা আনুগত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতি ও শৃঙ্খলার বিষয়। শিঘ্রই এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা- তিনি বলেন, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ আল স্বপন বলেন, জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাজ হচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করা। কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে দলের কার্যক্রম প্রচার ও দলকে জনপ্রিয় করে তোলা। যারা এটা না করে নিজেদের বলয় তৈরি করছেন বা দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন তাদের জন্য দল থেকে অব্যাহতি একটি বার্তা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সুচারুভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে দলেও পূর্ণ মনোযোগী। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি প্রতিনিয়ত তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তৃণমূল নেতাদের খোঁজ-খবর রাখেন। ফলে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে নেত্রী তাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন, এটিই স্বাভাবিক।
জানাযায়, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেবীদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের মধ্যে মতবিরোধ চলে আসছে প্রায় সাত বছর ধরে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদের বিপক্ষে সংসদ সদস্য তাঁর আপন চাচাকে উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করান। ওই নির্বাচনে সংসদ সদস্যের চাচা আজাদের কাছে হেরে যান। এর পর থেকে দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়। সুযোগ পেলে তাঁরা একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টায় থাকেন। যে কারণে গত (১৬ জুলাই) শনিবার বিকেলে সংসদ ভবনে দেবীদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভায় সংসদ সদস্য পুরোনো বিরোধ কাজে লাগিয়ে আজাদকে কিলঘুষি মারেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের অন্তত পাঁচজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ২০১৬ সালে দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আবুল কালাম আজাদের বাবা মো. নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। এতে তৎকালীন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল বিরোধিতা করেন। রাজীর বিরোধিতার পরও নুরুল ইসলাম জয়ী হন। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে আবুল কালাম আজাদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল তাঁর আপন চাচা এ এফ এম তারেক মুন্সীকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করান। তারেক মুন্সী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রায় ৬০ হাজার ভোট পান। নির্বাচনে রাজীর অনুসারী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ধানের শীষের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেন। এরপরও আজাদ চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেবীদ্বারের ১৫টি ইউনিয়নের বেশির ভাগে নৌকার প্রার্থী হেরেছেন। এ নিয়ে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান একে অন্যকে দোষারোপ করেন।
এদিকে গত ২ জুলাই সন্ধ্যায় দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় নবীয়াবাদ এলাকার কুমিল্লা মডেল কলেজে। ওই সম্মেলনে কোনো কমিটি ঘোষণা না করে সংসদ সদস্য পরে কমিটির নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানান। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের অনুসারীরা কমিটি ঘোষণার দাবিতে রাত সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সংসদ সদস্য রাজীর গাড়ি আটকে রাখেন। একই সঙ্গে বিক্ষাভ করেন। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার নির্দেশে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী বরকামতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। এরপর সংসদ সদস্য রাজীর গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে রাজী তখন ক্ষুব্ধ হন।
এদিকে গতকাল ২১ জুলাই বুহস্পতিবার দেবীদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হবার কথা ছিলো। এ নিয়ে গত ১৬ জুলাই বিকেলে সংসদ ভবনের এলডি হলে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ম. রুহুল আমিন। সভায় উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী, একই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, দেবীদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মনিরুজ্জামান, উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম সফিকুল আলম ওরফে ভিপি কামাল প্রমুখ।
ওই সভায় দেবীদ্বারের এলাহাবাদ ইউনিয়ন কমিটি অনুমোদনের প্রস্তাব করেন এক নেতা। তখন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। তখন রাজী এই কমিটি মানি না বলে আপত্তি জানান। তখন রাজীর পাশেই বসা ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ। তিনি দাঁড়িয়ে কমিটি সুন্দর হয়েছে, সম্মেলনে তাঁদের রাখার পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তখন পাশে বসা রাজী চেয়ার থেকে উঠে উপজেলা চেয়ারম্যানের মাথা, নাক, মুখে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কিলঘুষি মারতে থাকেন। এ সময় সভায় উপস্থিত সদস্যরা রাজীকে নিবৃত্ত করেন।
অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের মুঠোফোনে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এর আগে ঘটনার পর গতকাল তাঁকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
রাজীর ঘনিষ্ঠজন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘দুজনই আগামীতে এমপি হতে চান। তাই তাঁদের মধ্যে এত মতবিরোধ। ঢাকায় সংসদ ভবনের সভায় ঝামেলা ও গালাগালি হয়েছে।’
চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, ‘এটা পরিকল্পিত হামলা। দেবীদ্বার উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রস্তুতি সভা দেবীদ্বারে হবে অথবা চান্দিনায় উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে হবে। সেখানে না করে উত্তর জেলা সভাপতি ও এমপি সংসদ ভবনে সভা ডাকেন। আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে এমপি আমার ওপর হামলা করেন। তিনি আমার নির্বাচনে, আমার বাবার নির্বাচনে বিরোধিতা করেন। সারা দেশে বিএনপি ও ধানের শীষের কোনো ভোট নেই, খবর নেই। কিন্তু দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আমাকে পরাজিত করার জন্য তিনি তাঁর আপন চাচার পক্ষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীদের লেলিয়ে দেন। তখন প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও ভোটকেন্দ্রে রাজীর লোকজনের প্রভাবই সেটা বলে দেয়।’ তিনি বলেন, রাজীর নিজের ভোটকেন্দ্রে নৌকা ১৬ ভোট পায় উপজেলা নির্বাচনে। তিনি দলের কাছে এর বিচার চান।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম সফিকুল আলম ওরফে ভিপি কামাল বলেন, ‘দেবীদ্বারে মুন্সী পরিবারের বাইরে আর কেউ নেতা হতে পারবেন না। এ জন্য এত খোদ। এভাবে জনপ্রতিনিধির ওপর হামলা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী বলেন, ‘আজাদকে কিলঘুষি মারা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, উচ্চবাচ্য হবে। কিন্তু গায়ে হাত তোলা উচিত না।’
কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ম রুহুল আমিন বলেন, ‘দেবীদ্বারে এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে। এ থেকেই হাতাহাতি হয়।'
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবন লাগোয়া ভবনের ৫০ নম্বর কেবিনে ভর্তি আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তাঁর শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে বলে তাঁর কর্মীসমর্থকেরা জানিয়েছেন।
অপরদিকে এ ঘটনার পর থেকে স্থানীয় সংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুসারীরা তাদের পক্ষে বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ সভা সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন