আমার স্বামী ষড়যন্ত্রের শিকার : সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের স্ত্রী আনিকা

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কুমিল্লা : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ১১ বছর ধরে শিক্ষকতা করেন। যার বিরুদ্ধে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তাকেসহ অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে শনিবার (১৬) মার্চ রাতে আটক করেছে পুলিশ।

আটক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গুরা বাজার থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামে। তিনি রামচন্দ্রপুর রামকান্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে একই এলাকার অধ্যাপক আব্দুল মজিদ কলেজ ভর্তি হন। কলেজজীবনের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে ভর্তি হন। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন দ্বীন ইসলাম। তিনি ২০০৮-০৯ সালে ঢাবির মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতিও ছিলেন। সে সময় হলের সভাপতি ছিলেন সাইদ মজুমদার, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জিয়াউল হায়দার তুহিন। 

ছাত্রজীবন শেষ হলে জবির ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন দ্বীন ইসলাম। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।

সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের স্ত্রী আনতারা আনিকা বলেন, আমার স্বামী ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকুক তা অনেকে চান না।

তিনি বলেন, দ্বীন ইসলাম এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা আমরা জানি না। শুক্রবার সকালের পর থেকে তিনি আর বাসায় ফেরেনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তার কাছে কোনো মোবাইল ফোন নেই। শনিবার দুপুরে সামান্য কথা হয়েছে। এরপর থেকে তার সাথে আর আমাদের কথা হহয়নি। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও ভয়ে আছি। আমার স্বামী এ ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত নয়। তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে।

তবে অবন্তিকার মৃত্যুর পেছনে নিজের কোনো দায় মানছেন না দ্বীন ইসলাম। তার দাবি, তিনি অফিশিয়ালি যে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সে অনুযায়ী তিনি তা পালন করেছেন। উল্টো নিজ এলাকার মানুষ হওয়ায় অবন্তিকা ও তার পরিবারকে তিনি যথেষ্ট সহায়তাও করেছেন।

শনিবার (১৬ মার্চ) গ্রেফতারের আগে এক সাক্ষাৎকারে দ্বীন ইসলাম বলেন, ঘটনা প্রায় দেড় বছর আগের। অবন্তিকার ব্যাচমেটরা কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। ফেসবুকের কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। জিডি করার সময় অবন্তিকাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ তখন উচ্চতর তদন্তের আশ্বাস দিয়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গুজব ছড়ানো আইডির পরিচালককে ধরার আশ্বাস দেয়। পরে থানা থেকে বেরিয়ে অবন্তিকা তার বন্ধুদের ফেসবুকের ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে সে গুজব ছড়ায় বলে জানায়। আর এর জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করে। পরে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা প্রক্টর অফিসে এসে অবন্তিকার বিরুদ্ধে গত ২০২২ সালের ৮ আগস্ট তারিখে একটা লিখিত অভিযোগ দেন।

দ্বীন ইসলাম আরও জানান, ‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল আমাকে এবং সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহাকে (গণিত বিভাগ) গত ১১.০৮.২০২২ ইং তারিখে তদন্তের দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে গত ১৬.০৮.২০২২ তারিখে প্রক্টর স্যারের উপস্থিতিতে আমি এবং সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা অবন্তিকা এবং তার অভিভাবকদের প্রক্টর অফিসে আসার জন্য আহ্বান করি। পরে অবন্তিকার মা মিটিংয়ে আসেন এবং অবন্তিকার ক্লাসমেটসহ (অভিযোগকারীরা) সবাই উপস্থিত ছিলেন।’  

সে সময় অবন্তিকার মা তার ব্যাচমেট (যারা এ অভিযোগ করেছেন) তাদের কাছে ঘটনার সত্যতা শুনে বলেন যে, ‘আমার মেয়ে যা করেছে ভুল করেছে, ঘটনার জন্য অভিযোগকারী সবার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে আমার মেয়ে আর এই ধরনের কাজ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যদি সে এমন কিছু করে তার দায় আমরা নিবো।’

সে সময় বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অবন্তিকার মা অনুরোধ জানান এবং বলেন, আমার মেয়ে ভালো শিক্ষার্থী। কিন্তু সে কয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং ওষুধ খাচ্ছে।

তখন তার ব্যাচমেটরা বিষয়টা মানবিক এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন। এভাবে বিষয়টা প্রাথমিকভাবে মীমাংসা করা হয়। মীমাংসার পর অবন্তিকার মা জিডিটা তুলে নেয়ার জন্য অভিযোগকারীদের অনুরোধ করেন। কিন্তু অভিযোগকারীরা জিডি তুলে নিতে অসম্মতি জানান, কারণ তাদের ধারণা অবন্তিকা ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ আবারও করতে পারেন।

সহকারী প্রক্টর হিসেবে জিডি তোলার বিষয়ে কিছু করার ছিল না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুধু প্রতিবেদন দেয়ার অধিকার রাখি। অবন্তিকা ও তার পরিবারের সদস্যদের আমি এ বিষয়ে জানিয়ে প্রক্টর স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেই। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও অনুরোধ জানাই বিষয়টি মীমাংসা করতে।’

তবে অভিযোগকারীরা জানান, তারা অবন্তিকাকে আগামী ৩ মাস পর্যবেক্ষণ করবেন এবং যদি সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে জিডিটা তুলে নেয়া হবে। এর কিছুদিন পর অবন্তিকা ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং আমাকে প্রক্টর অফিসে না পেয়ে আমার বিভাগে আসেন। ওইদিন অবন্তিকার মা আমাকে জানান, অবন্তিকার হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন না, এতে সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েছে। তখন আমি তাদেরকে প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দেই। তখন অবন্তিকার মা বলে, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাইছি না।’

তখন তিনি বলেন, আমি মেয়েকে আর হলে রাখব না, এতে তার পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। তখন আমি তাকে বলি আপনি অভিভাবক, যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। যে কোনো প্রয়োজনে আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। অভিযোগ নিষ্পত্তির ৩ মাসেরও কিছুদিন পর অবন্তিকা এবং তার বাবা-মা প্রক্টর অফিসে জিডি তোলার জন্য আসেন, কিন্তু তার ব্যাচমেটরা জিডি তুলতে অসম্মতি জানান।

তখন অবন্তিকার মা-বাবা এবং অবন্তিকা আবার আমাকে ফোন করে আমার বিভাগে দেখা করতে আসেন।

তখন তারা জিডি তোলার বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি যে, বিষয়টা আমার হাতে নেই। আমাদের কাজ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করা এবং আমরা তাই করি। জিডির বিষয়ে প্রক্টর স্যার এবং অভিযোগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে নিষ্পত্তি করার পরামর্শ দেই।

‘সে সময় অবন্তিকার মা কিছুটা হতাশার ভাষায় বলেন, আমি দুজন (অবন্তিকা এবং ওর বাবা)  ডিপ্রেশনের রোগীকে নিয়ে এত বছর সংসার করে আসছি। আমি নিজেও অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং বলেন আমার মেয়েটা মারাত্মক ডিপ্রেশনে পড়ে গেছে। এরপর অবন্তিকা ও তার পরিবারের কারো সাথে এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি,’ বলেন অভিডুক্ত দ্বীন ইসলাম।

মৃত্যুর আগে ফেসবুকে দেয়া অবন্তিকার স্ট্যাটাস নিয়ে গ্রেফতার দ্বীন ইসলামের দাবি, ‘প্রথমত আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, আম্মানকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ঘটনা নিষ্পত্তি হয় ১৬.০৮.২০২২ সালে। এরপর এই বিষয় নিয়ে আর কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি কখনোই।’

এছাড়া প্রক্টর অফিসে অবন্তিকা এবং তার মাকে একবারই ডাকা হয়েছিল। সেই সময় প্রক্টর মোস্তফা কামাল, সহকারী প্রক্টর গৌতম সাহা এবং অভিযোগকারী ও তার বন্ধুরা উপস্থিত ছিলেন। একাধিকবার ডেকে হেনস্তা করার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। কারণ, বিষয়টি ওইদিনই মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল।

‘সুইসাইড নোটে প্রক্টর অফিসে আম্মানের বিরুদ্ধে আনীত যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগের বিচার না পাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল ভালো বলতে পারবেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে আমি অবগত নই,’ বলেন তিনি।

দ্বীন ইসলাম সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমি ১১ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অনেক শিক্ষার্থীকে খারাপ অবস্থা থেকে তুলে এনেছি। আমি বলতে চাই, অবন্তিকার মৃত্যুর পেছনে বারবার জিডির বিষয়টি উঠে আসছে। ওই বিষয়ে কেবল প্রক্টর স্যার এবং অভিযোগকারীরাই ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আমি কোনোভাবেই দায়ী নই।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন