কোটা আন্দোলন : নিহত শিশু হোসাইনের গ্রামের বাড়ি দেবীদ্বারে শোকের মাতম

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কুমিল্লা : কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ১০ বছর বয়সী শিশু হোসাইনের বাড়িতে এখনো চলছে মাতম। আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই দুপুরে রাজধানীর চিটাগাং রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলাকালে হোসাইনের বুক ও তলপেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় হোসাইন। 

পরে গত ২২ জুলাই রাত ২টায় তার মামারবাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতোরা গ্রামে লাশ দাফন সম্পন্ন হয়।

শনিবার বিকেলে সরেজমিনে বেতোরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় শোকার্ত মানুষের ঢল।


স্বজন-প্রতিবেশীরা নিহত হোসাইনের মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তারা কোনো সান্ত্বনাই মানছেন না। হোসাইনের মা-বাবা মোবাইল ফোনে সন্তানের ছবি দেখে শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মা চিৎকার করে বলছেন, ‘আন্দোলন আমার বুকের ধন কেড়ে নিল।

নিহত হোসাইনের মা মালেকা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছিল। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ ও ককটেল বিস্ফোরণ, টিয়ারশেলে পুরো এলাকা প্রকম্পিত ও অন্ধকার হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত বাসাবাড়ির লোকজন দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। কেউ ঘরে, কেউবা ছাদের ওপর থেকে গোলাগুলির দৃশ্য দেখছেন।

মানুষের শোরগোল আর আর্তনাদ চলছিল। 

আমার মানিক ধনকে বলি বাবা ঘর থেকে বের হয়ো না। দুপুরের দিকে খাবার খাইয়ে দিই। সে আমাকে বলে, ‘মা খেলনার গোলাগুলি হচ্ছে, পটকা ফুটাচ্ছে, ফাঁকা গুলি ছুড়ছে, কিছু হবে না, ভয় পেয়ো না। কিছুক্ষণ পর আমার ছেলেকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

তখন তার বাবা বাসার বাইরে ছিল। পরে বুঝলাম, সে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকোলেট ফেরি করে বিক্রি করতে বেরিয়ে গেছে।’

তিনি জানান, বিকেল গড়িয়ে গেলেও বাসায় ফেরেনি হোসাইন মিয়া। তার বাবা বাসায় ফিরে আসেন। পরে সন্তানের খোঁজে তার বাবা মানিক মিয়া বের হন। চিটাগাং রোডসহ আশপাশের এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেও হদিস মেলেনি হোসাইনের।

রাত ৯টার দিকে কেউ একজন এসে মুঠোফোনে হোসাইনের ছবি দেখান। মানিক ও মালেকা সন্তানের আহত অবস্থার ছবি দেখে চিনতে পারেন। তারা জানতে পারেন, হোসাইনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে এক রিকশাওয়ালাকে হাতে-পায়ে ধরে রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছান। 

চিকিৎসকদের কাছে গেলে তারা বলেন, চিটাগাং রোড এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অনেককেই আনা হয়েছে। আহত সবার চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকদের কাছে অনেক অনুরোধ করেও তাদের সন্তানকে দেখার সুযোগ পাননি। চিকিৎসকের কথায় হাসপাতালের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিলেন, চিকিৎসা শেষ হলে সন্তানকে দেখতে যাবেন। রাত ২টায় একজন নার্স এসে তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেন এখানে বসে আছেন, পরে নিজের সন্তানের কথা বলেন। তখন ওই নার্স বলেন, ছেলের নাম কি হোসাইন? তারা বলেন, হ্যাঁ। তখন তাদের লাশঘরের কাছে নিয়ে যান। অনেক মরদেহের সঙ্গে ছোট্ট হোসাইনের মরদেহ দেখে বাবা মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। 

মা মালেকা বেগমের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিক্যালের পরিবেশ। যে বয়সে লেখাপড়া আর খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা, সে বয়সে বাবার সঙ্গে পরিবারের অভাব ঘোচাতে ১০ বছর বয়সী হোসাইন মিয়া ফুটপাতে, রাস্তায়-পার্কে-বাসস্টেশনে ঘুরে ঘুরে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকোলেট ফেরি করে বিক্রি করত।

এদিকে হোসাইনের মরদেহ ২২ জুলাই রাত ২টার দিকে নানাবাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারের রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে দাফন করা হয়েছে। নিহত হোসাইনের মামা মোস্তফা কামাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘হোসাইনের পরিবার ঢাকায় থাকলেও তারার তেমন কিছু নাই। বাপ-ছেলে ফেরি করে যা পায়, তা দিয়ে তাদের সংসার চলত।’

নিহত হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে শনিবার বিকেলে মারা গেছে। তার বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর একটি গুলি তলপেটে বিদ্ধ হয়েছে। তার লাশ আনতে গিয়ে আমাদের অনেক বিপদে পড়তে হয়েছে। এই অফিসে যাও, সেই অফিসে যাও। শাহবাগ থানায় গিয়ে জিডি করো। কত স্বাক্ষর দিতে হয়েছে, কত যে হয়রানির শিকার হয়েছি। তারপর সোমবার ১০ হাজার টাকায় অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়ায় ছেলের লাশ আনতে পেরেছি। এই লাশ আনতে গিয়েও বিপদের শেষ ছিল না।’

দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা জানান, তিনি গতকাল শুক্রবার নিহত শিশুর বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নগদ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন