কুমিল্লার ৪০ নারী একদিকে গৃহিনী অন্যদিকে সাংবাদিক

ফাহিমা বেগম প্রিয়া, কুমিল্লা : কুমিল্লা থেকে প্রথম প্রকাশিত ত্রিপুরা হিতৈষী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন গুরু দয়াল সিংহ। এই পত্রিকাটি পরবর্তীতে সম্পাদনার দায়িত্ব পান গুরু দয়াল সিংহেরই উত্তরসূরী উর্মিলা সিংহ। ঊর্মিলা সিংহ-ই ছিলেন কুমিল্লার প্রথম মহিলা সম্পাদক। এই ঊর্মিলা সিংহ বাংলাদেশের প্রথম মহিলা সম্পাদক বলেও অনেকের অভিমত। সেই হিসেবে বর্তমান সময়ে কুমিল্লার সাংবাদিকতায় মেয়েদের অংশগ্রহণ খুবই কম।

কুমিল্লা জেলা তথ্য অফিস বলছে তাদের ডাটাবেজে এ জেলায় ৪০ জন নারী সাংবাদিক তাদের নিবন্ধন করেছেন। তবে নিবন্ধনের বাহিরে আরো অনেকে রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বর্তমানে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আমোদ’-এর সম্পাদক মরহুমা শামসুননাহার রাব্বী কুমিল্লার সাংবাদিকতায় একটি বিশাল আসন দখল করে রেখেছিলেন। দৈনিক রূপসী বাংলার সম্পাদক হাসিনা ওহাব বর্তমানে পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করলেও আরও অনেক গুণী সাংবাদিকের স্ত্রীগণ সাংবাদিকতায়, সম্পাদনায় এগিয়ে আসেননি। হাসিনা ওহাব একদিকে গৃহিনী অন্যদিকে সাংবাদিক।

কিন্তু দৈনিক ইত্তেফাকের আজীবন কুমিল্লার প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা চৌধুরী পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। এ সময়ে ইয়াসমিন রীমা ‘বর্ণপাঠ’ পত্রিকা বের করলেও পত্রিকাটিকে বাজারে আর দেখা যায় না। ইয়াসমীন রীমা একসময় ‘পাঠকবার্তা’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমানে ‘দি নিউ এইজ’ পত্রিকার কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাপ্তাহিক বাংলার আলোড়ন পত্রিকার সম্পাদক ফারহানা শারমিন হলেও এর প্রায় সকল দায়িত্ব পালন করেন পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক মো: রফিকুল ইসলাম। সাপ্তাহিক ‘আমোদ’ সম্পাদক শামছুনাহার রাব্বীর বড় মেয়ে আকীলা রাব্বীসহ তার তিন মেয়ে কুমিল্লায় সাংবাদিকতায়, লেখালেখিতে দক্ষতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখলেও বর্তমানে তারা সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। কুমিল্লায় জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশের বরেণ্য সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান তার সংস্থা-‘বিসিডিজেসি’ কর্তৃক কুমিল্লার মেয়েদের সাংবাদিকতা বিষয়ে একাধিকবার প্রশিক্ষণ দিলেও প্রশিক্ষণের পরপরই ওরা হারিয়ে গিয়েছে। সেই প্রশিক্ষণ পাওয়া মেয়েদের মধ্য থেকে মুরাদনগর উপজেলার কাজিয়াতল গ্রামের ফাহিমা বেগম প্রিয়া একসময় করতোয়া ও ভোরের কাগজ পত্রিকায় ও ঝাউতলা খ্রিষ্টানপাড়ার কাজী মিজানুর রহমানের মেয়ে কাজী উম্মে সালমা (সানজু) ও শাহীনুর সুলতানাকে একসময় কুমিল্লার কাগজ পত্রিকায় চাকুরি দেয়া হলেও বর্তমানে ফাহিমা বেগম প্রিয়া (আজকালের খবর) ছাড়া ওরা দু’জন আর কুমিল্লার কাগজে চাকুরি করেন না। সাপ্তাহিক আমোদ-এর বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাকীন রাব্বীর স্ত্রী শাহানা রাব্বী সাংবাদিকতা বিষয়ক অনেক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিকতায় আসেননি। তবে গৃহিনী হলেও কুমিল্লার সাপ্তাহিক অভিবাদন পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পারভীন হাসানাত সাংবাদিকতার সঙ্গে সিরিয়াসলি জড়িত। কাগজের পেস্টিং থেকে শুরু করে কাগজ ভাঁজ করে টিকেট লাগিয়ে পাঠকের কাছে কাগজ পাঠানোর ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা-তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একজন সৎ সাংবাদিকের ঠিক যতটা ত্যাগী স্ত্রী দরকার-তিনি ঠিক ততটাই। দৈনিক কুমিল্লা বার্তা পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মফিজুর রহমানের মেধাবী কন্যা ফারজানা লোপা জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে লেখাপড়া করেছেন। তিনি অনেক সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেননি। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেননি দৈনিক রূপসী বাংলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওহাবের কন্যাগণও। তবে কুমিল্লার বিভিন্ন পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে অনেক নারীর নাম ছাপা হয়। তবে তাদের সবাই সাংবাদিক নন-কেউ কেউ সাংবাদিক হলেও পেশাদার নন। সাপ্তাহিক নিরীক্ষণের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী কাজী ফাতেমা বেগম-এর নামে পত্রিকাটির রি-ডিক্লারেশন দেয়া হলেও মূলত গৃহিনী হিসেবেই তিনি পরিচিত। সাপ্তাহিক কুমিল্লা দর্পণ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে নাগমা মোর্শেদ-এর নাম ছাপা হলেও সাংবাদিকতায় তিনি পেশাদারী নন। এ ক্ষেত্রে দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহা ব্যতিক্রম। তার স্ত্রীও শিক্ষিত। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু তিনি সাংবাদিকতা করেন না বলে নীতিশ সাহা তাকে পত্রিকাটির কোনো পদে রাখেননি , এমনকি তার নাম প্রিন্টার্স লাইনেও ছাপেন না। সাপ্তাহিক নতুনপত্রের প্রিন্টার্স লাইনে নাম ছাপা হয় এডভোকেট শামসুন্নাহার বাকীর। কিন্তু তিনিও সাংবাদিকতায় পেশাদারী নন। দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহার বড় ভাই আশিষ সাহার মেয়ে দীপান্বিতা সাহা ঊর্মি একসময় খুব ভালো লিখতেন এবং ভালো ছবিও আঁকতেন। ঊর্মি বর্তমানে ডাক্তার হয়েছেন। সুতরাং সাংবাদিকতায় আসার সম্ভাবনা আর নেই। কুমিল্লার প্রবীন সাংবাদিক দেবীদ্বারের এবিএম আতিকুর রহমান বাশারের স্ত্রী হুরবানু আক্তার পলি ও তার বড় কন্যা তাসকিয়া রহমান প্রতিভা নিজেদের ঘর সামলে এখনো বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করে আসছেন। কুমিল্লার ‘বর্ণপাঠ’ সম্পাদক ইয়াসমিন রীমা একসময় কুমিল্লার শিক্ষানবীশ সাংবাদিক মেয়েদের নিয়ে গঠন করেছিলেন ‘উইমেন ইন মিডিয়া ফোরাম-কুমিল্লা’। পরে সেটির কার্যক্রম একেবারে স্থবির হয়ে যায়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের এক ছাত্রী সানন্দা রুবী সাপ্তাহিক আমোদসহ বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে সাংবাদিকতা করেননি আর। বাড়ি ছিলো তার কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরববাজারের লক্ষ্মীপুর মোল্লা বাড়িতে।

সাপ্তাহিক কুমিল্লা দর্পণ পত্রিকার নাগমা মোর্শেদ, ফারহানা মরিয়ম আঁখি ও ফাখেরা মনসুর এর নামে বিভিন্ন রিপোর্ট ছাপা হলেও তারা সাংবাদিকতায় পেশাদারী নন। কুমিল্লা শহরের রাণীর বাজার লুনাবাদ পুকুরের পশ্চিমপাড়ের আবুল মনসুরের মেয়ে ফাখেরা মনসুর সাংবাদিকতার অনেক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তবে তিনি মূলত একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। সাংবাদিকতায় পেশাদারী নন-শৌখিন। যদিও একটি পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনেও তার নাম ছাপা ...। সাংবাদিক বাচ্চু বকাউলের স্ত্রী মেহেরুননেছা বকাউল বর্তমানে বিভিন্ন পত্রিকায় রুমা বকাউল নামে লেখালেখি করলেও পেশাদারী চিন্তা থেকে লেখালেখি করছেন না। গৃহকর্মের পাশাপাশি শখের বশে লিখছেন। কুমিল্লার বুড়িচং-কালিকাপুর এর জাহাঙ্গীর আলম জাবির পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তার স্ত্রী সেলিনা আক্তার সুমিও কিছুদিন পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। কিন্তু সেই লেখালেখি সাংবাদিকতার পর্যায়ে পড়ে না। সেসব শৌখিন লেখালেখিই কুমিল্লার গল্পকার মামুন সিদ্দিকীর ছোটবোন নাসরিন লিপি ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করেছেন। বিয়ের আগে তিনি সাংবাদিকতার একাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও পরে সাংবাদিকতা করেননি আর। কুমিল্লা শহরের পুরাতন চৌধুরী পাড়ার এডভোকেট সাইদুর রহমানের মেয়ে নূরজাহান বিলকিস ‘বিসিডিজেসি’ আয়োজিত সাংবাদিকতার একাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার আগে রীতিমত কমিটমেন্ট দেখালেও প্রশিক্ষণ শেষে এ অঙ্গন থেকে উধাও।

এডভোকেট নাহিদ সুলতানা মুক্তির ছোটবোন তৌহিদা সুলতানা শেলী কসমেটিক ব্যবসা করতেন। সাংবাদিকতার অনেক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত কবিতা লেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলেন। কুমিল্লার কাগজের এক সময়ের সাংবাদিক শাহিনুর সুলতানার বড় বোন নুরুন নাহার সুলতানা শর্মী কিছুদিন পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আর এগোননি। কুমিল্লার খেলাঘর-এর রাশেদা আখতার এর মেয়ে আফরোজা হাসান সুবর্নার অবস্থাও একই। তেমনিভাবে বর্ণালী চক্রবর্তী, নাহিদা আক্তার নিঝুম, সুরভী দে সরকার, মিতু পাল-আরও অনেকের নাম উল্লেখ করা যাবে। কুমিল্লায় নারী সাংবাদিকতা এখনও পেশাদারী ভূমিকায় নেই। নারী সাংবাদিকদের কোনো সংগঠন নেই। আর প্রকাশনা? কুমিল্লা কোনো পুরুষ সাংবাদিকদেরও কোনো নিয়মিত জার্নাল নেই বর্তমানে। সারা বাংলাদেশে যেখানে পেশাদার পুরুষ সাংবাদিকের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি-সেখানে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩০০ জন। কুমিল্লাও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ স্তরে যে কয়েকজন নারী সাংবাদিক রয়েছেন-তারাও মূলত এসেছেন সাংবাদিক পরিবার থেকে-বিশেষ করে স্বামী কিংবা তাদের স্বজনদের হাত ধরে। আর্টিকেল নাইনটিন এর প্রোগ্ বলেন-সাংবাদিকতা সব দিক দিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা-যদিও এ পেশা সম্ভাবনারও। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে একাধিক সন্ত্রাসী হামলায় শিকার বর্তমানে দৈনিক তৃতীয় মাত্রা পত্রিকায় কর্মরত ফাহিমা বেগম প্রিয়া বলেন অন্যভাবে-‘মেয়েদের সনাতন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে সাংবাদিকতায় মেয়েরা সফল হতে পারবে না।’

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন