বাংলাদেশে ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা, রাষ্ট্র নীরব

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন | দ্য ডেইলি জয় বাংলার জয়

ফাহিমা বেগম প্রিয়া : 

একজন সাংবাদিক খুনের মামলার আসামি হতে পারেন—এই কথা শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন ‘অবিশ্বাস্য’ ঘটনাই এখন বাস্তবতা, তাও একশ দু'শ নয়—পুরো ২৬৬ জন সাংবাদিক এই মুহূর্তে খুন বা সহিংসতার মামলার আসামি। অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার।

মৌলিক প্রশ্ন: সাংবাদিক না অপরাধী?

সাংবাদিকদের কাজ হলো প্রশ্ন করা, সত্য খোঁজা এবং জনস্বার্থে কথা বলা। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজ বহু সাংবাদিকের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগে—যেগুলোর বেশিরভাগই প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিচারহীনতার ভেতরে ডুবে আছে।

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ৪ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে বলেন, “২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খুন-সহিংসতার মামলা চলমান। এটা কীভাবে সম্ভব? এটা আমাদের জন্য চরম অসম্মানের।”

ডিজিটাল আইন থেকে হত্যা মামলা: এক ভয়ঙ্কর গতিপথ

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা নতুন নয়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পেরিয়ে এখন তারা খুন, অপহরণ, বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নের মতো ফৌজদারি মামলার লক্ষ্যবস্তু।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ২০০+ সাংবাদিক

খুন বা সহিংসতা মামলা: ২৬৬ জন

রাষ্ট্রদ্রোহ ও ICT আইন: ৪৩ জন

তদন্তে অগ্রগতি নেই: প্রায় ৭০%

এই মামলাগুলোর বেশিরভাগে সাংবাদিকরা গ্রেফতার হয়েছেন, জামিন পাচ্ছেন না, কিংবা আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, অনেকে পরিবারসহ অন্য জেলায় পালিয়ে গেছেন।

কুমিল্লার মুরাদনগরের উদাহরণ: শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক সাংবাদিকরা

শরিফুল আলম চৌধুরী, কুমিল্লা জেলার একজন রিপোর্টার, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় খুনের মামলায় ৪ নম্বর আসামি হিসেবে। তার একমাত্র অপরাধ—স্থানীয় ইউএনও ও এমপি ও মাদককারবারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ।

ফাহিমা আক্তার প্রিয়া, কুমিল্লার নারী সাংবাদিক, মাদককারবী ও অবৈধ বালু ব্যবসার ঘটনার রিপোর্ট করে জড়ান দুটি মামলা—একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, অন্যটি ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ মন্তব্যের অভিযোগে।

রাষ্ট্রের নীরবতা: অপরাধীদের প্রেরণা

এই মামলাগুলোর তদন্ত এক জায়গা থেকে নড়ে না। বিচার হয় না। কোনো মন্ত্রীর বক্তব্য আসে না। প্রশাসন দায় নেয় না। বরং আইন উপদেষ্টারা বলেন, “জনগণ মামলা করতেই পারে।”

সাংবাদিক নেতা মাহফুজ আনাম বলেন, “একটি মামলাও যদি হয়রানিমূলক প্রমাণিত হয়, রাষ্ট্রকে অবশ্যই তাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে

বাংলাদেশ গত বছর RSF-এর (Reporters Without Borders) প্রেস ফ্রিডম সূচকে নিচের দিকে নেমেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাও সাংবাদিকদের হয়রানিমূলক মামলার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: সত্য বলার শাস্তি : আজ যারা খুনের মামলার আসামি, কাল তারা হয়তো বিনা বিচারে জেলে যাবেন। একজন সাংবাদিক জানালেন, “আমি এখন আর রিপোর্ট করি না। শব্দে খরচ বাড়ে, মামলায় ঝুঁকি বাড়ে।”

শেষ কথা : বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন আর কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ নয়—এটা এখন একটি বিপজ্জনক পেশা। যখন রাষ্ট্র নীরব, সমাজ চোখ ফিরিয়ে নেয়, তখন মিথ্যাই জিতে যায়।

সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধ। আর সাংবাদিকতা? সেটাই এখন বিচারের কাঠগড়ায়।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন