কাউকে অসম্মান করা নিজের জন্য সম্মানের নয়: এডভোকেট ইসমত শিল্পী

 

আমার ছেলের কাছে আমার প্রত্যাশা খুব কম। পরিচিতজন এবং পরিবারের কাছে তো নেইই। দুয়েকজন শুভাকাঙ্খী নেই বললে মিথ্যে বলা হবে; তাঁদের কাছে ছিটেফোটা দাবী রাখি মাঝেমধ্যে। খুব স্বল্পতম এই সম্মানীয় সম্পর্কগুলো। 

দীর্ঘদিন একলা চলা জীবন- অনেক সুফল বয়ে এনেছে তা আমি দাবি করি না কখনো। কিন্তু অনেক কিছু শিখেছি এটা ঠিক। নিজের উপর ১০০% নির্ভর করে চলতে পারি। নিজের উপর নির্ভর করে চলতে পারা একটা বিরাট দক্ষতা। কষ্ট হলেও স্বস্তিদায়ক এই চলা।

যখন চাকরি ছিল না, তখনও আমার পরিবারের কাউকে জানতে দিইনি। প্রায় শূণ্য হাতে ছেলেকে নিয়ে চলে আসি ঢাকায়। ২০০৩ এর ফেব্রয়ারিতে চাকরি হয় পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র; ব্রাঞ্চ ইনচার্জ, পোস্টিং নেত্রকোণা। কিন্তু সেই চাকরি অঅমার করা হয়নি পাঁচ মাসের বেশি। কারণ তখন আমি মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সী! লম্বা চুল, শাড়ি পরে চলি। আমার জন্যে মোটর বাইক বরাদ্দ ছিলো কিন্তু রিকসায় চলতাম। নেত্রকোণা খুব পছন্দের ছিল, প্রচর কবিতা লিখতাম কথন। ২০০৪ সালের প্রথম কবিতাগ্রন্থে সেসব কবিতা আছে। 

২০০৩ এর জুলাই; হঠাৎ যখন অসুস্থ হলাম, অপারেশন করতে হলো; আমি একা একা সমস্ত টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে একা একা হাঁটতে হাঁটতে অপারেশন রুমে ঢুকেছি। মা বসে হায় হায় করে আর সুদীপ্ত ছয় বছরের শিশু ছুটোছুটি করে বেড়ায়। আমি স্যালাইন নিয়ে বসে বসে মা’কে সাহস দিই। সুদীপ্তর সাথে হাসাহাসি মজা করি। ওদেরকে কাঁদানোর অনিচ্ছা-- আর সেই অধিকার আমাকে কে দিয়েছে! অপারেশন রুমে গিয়ে অন্ধকার আর মেডিসিনের গন্ধে ভরে আসছিল বুক, কিছুটা ভারি লাগছিল শরীরটা। নার্সদের নিষেধ অমান্য করেছিলাম, নিজেকে একটু শক্ত রাখার চেষ্টায়। কিন্তু হেঁটে হেঁটে ওটি টেবিলে বসে নিজেকে আরেকটু স্বীকৃতি দিয়েছি সেদিন। 

নিজেকে নিজে স্বীকৃতি দিতে জানলে সাহস বাড়ে এইটা আমার শ্রেষ্ঠ জানা। আমার অভাব জানানোর অভ্যেস নেই, কেঁদে কেঁদে ইনিয়ে বিনিয়ে জীবনের হা পিত্যেশ প্রকাশ করে কারোর দয়া পেতে ভালো লাগে না। আমার চুড়ান্ত অসুস্থতার কথাও খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে অবলিলায় বলতে পারি। কেন পারি জানি না। এমনকি পা ভেঙ্গে একবার হসপিটালে গিয়েছি ২০১৪ তে। -- বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম; মনে পড়ে- আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় দেখতে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কার পা ভেঙেছে! কারণ আমি তখন খুব স্বাভাবিকভাবে আরেকটা চেয়ারে পা তুলে বসে পাশের রোগীর সাথে কথা বলছিলাম। 

মা বাবা ছেলে সহ বেশ কিছু রিলেটিভের ট্রিটমেন্টের জন্য হসপিটাল ডাক্তার আমাকে করতে হয়েছে বহুবার। আমার আব্বা বলে, আমি নাকি এসব খুব ভালো পারি। আসলে এসব করতে করতে এতো ভালো পারি। আর আমার সমস্ত অসুখের ও যন্ত্রণার সাক্ষী কেবল আমিই। কারোর উপর নির্ভর না করতে করতে সেই অভ্যাস গড়ে ওঠেনি কখনো। নিজের বাজার করা থেকে শুরু করে বাজারের টাকার জোগান আমাকেই করতে হয় বৈকি। নিজের অসুখ এবং ঔষধ যোগানোর চেষ্টাও আমার একার। এই যে ্ছরে কয়েকবার ভারতে যাচ্ছি ২০১৮ থেকে চোখের চিকিৎসার জন্যে। ভিসা করা, টিকট করা, ওখানে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা থেকে মেডিসিন সংগ্রহ সবকিছুর ভার আমার-ই। আমার ভারতের চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই বিন্দুমাত্র না জেনেই হালকা মন্তব্য করে থাকেন। কারণ আমার বেড়ানোটা আমি দেখাই, চিকিৎসার অবস্থা নিয়ে কোনো স্ট্যাটাস আমি দিই না। এসবের জন্যে অিামার ভাই, আমার বন্ধসহ শিক্ষকসহ অনীত রায় দাদা না থাকলে সহজ হতো না ব্যাপারটা- ওটা অস্বীকার করলে পাপ হবে। মাসীমা আমার আরেক মা...

২০০২এ যখন ছেলেকে নিয়ে একলা জীবনের সাঁতার শুরু সেইসময় মোবাইল ফোন ছিল না; কারোর সাথে যোগাযোগ করা অসম্ভব ছিল। একসময়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও লেখক এই আমি সময়ের তালে তালে ভাসতে ভাসতে সমসাময়িক বন্ধুদের থেকে খুব দূরে সরে এলাম। কেউই জানলো না, আসল ঘটনা কি! অনেকেই নিজের মতো ভেবে নিয়েছে, জেনেছি। পরবর্তীতে অনেকের সাথে যোগাযোগ ও দেখা হয়েছে তখন আমার চুড়ান্ত দুঃসময় কিছুটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সবাই জেনেছে, আমি বেশ ভালো আছি।

সে-ই ভালো। খারাপ থাকার গল্প করতে আমার ভালো লাগে না। কষ্টের কাহিনী যত চাপা পড়ে যায় ততই মঙ্গল। অতীতের কথা আলোচনা করার ইচ্ছে হয়নি তাই কখনো কারোর কাছে গল্প করা হয়নি সেসব। অনেক সত্যি বলা হয় নি আজও।

ওসব বলে কীইবা লাভ! বেশ কয়েকটা চাকরি করেছি। চাকরির পাশাপাশি নিজের মাইনের টাকায় এল এল বি করেছি, বার কাউন্সিল পরীক্ষা দিয়েছি। এডভোকেট হয়েছি; স্বাধীন একটা পেশা নিজের জন্য নির্ভরযোগ্য অবলম্বন। আব্বার পছন্দ না এডভোকেসি। তাই এইটা নিয়ে তাঁর কোনো উৎসাহ নেই।

এই কথাগুলো বললাম একটা বিশেষ কারণে।

সুদীপ্তর বাবার বিষয়ে আমি কখনো কোনো কথা বলতে চাইনি। কারণ:

* যে সম্পর্ক অতীত তা আলোচনা করা নিরর্থক মনে হয়।

* তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করার ফলে আমি চলে এসেছি এটা আমার মনে হয়, কারোর জন্যেই সম্মানের নয়।

* কাউকে অসম্মান করা নিজের জন্য সম্মানের নয়, এইটা আমার বুঝ।

* অনেকেই বলতে পারেন আমি চলে না এসে থাকতেই পারতাম। কিন্তা সেটা কি আদৌ সম্মানের হতো? সুদীপ্ত সহ সবার জন্য!

*সুদীপ্ত তখন পাঁচ। সেই বয়সে এরকম বাজে পরিবেশ মনের উপর কি ভালো প্রভাব ফেলতো? 

**সুদীপ্তর বাবা ছেলের কোনোরকম ভরন পোষন করে না। তেমন খোঁজও নেয় না। তাতে আমার কোন মন্তব্য নেই কখনোই। কারণ এতে করে ছেলের মন ছোট হতো।

**আমি নিজে যেচে সুদীপ্তকে পাঠাতাম আগে মাঝেমধ্যে- ওর দাদার বাড়িতে। আমি চেয়েছি, ছেলের সহজ স্বাভাবিক আসা-যাওয়া থাকুক। কিন্তু ওর বাবা যেহেতু তেমন যোগাযোগ করে না তাই ছেলে নিজেই বিরক্ত এখন। 

***আমি তার সাথে আইনগতভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি মাত্র। কোনো সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখা সম্মানের না তাই এই কাজটি খুব তাড়াতাড়িই করেছি। কিন্তু কোনোরকম আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া অরুচিকর মনে হয়েছে।

***নিজের রুচির বাইরে কেউ কিছু ঘটালে সেইটার মধ্যে পেঁচিয়ে থাকা মর্যাদাপূর্ণ কোনো কাজ না। অরেকজনকে সাজা দিতে নিজেকেও ওই স্তরেই ছুটতে হয় এ তো ঠিক। এতে সম্মান থাকে?

তাই স্রেফ কাটছাঁট করে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করাটা উত্তম।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন