আজ শুভ জন্মাষ্টমী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন মানে মালপোয়া, তালের বড়া, ক্ষীর পায়েস খাওয়ার উৎসব।
আমি উৎসবে খাওয়া দাওয়ার গল্প ছাড়া আর কিছু জানি না। বিশেষ করে ধর্মের কথা। ধর্মীয় গল্প খুব ভালো জানে আমার মামাতো বোন টুম্পা।
নিউইয়র্কে বিশাল চাকরি, সাথে সংসারে ব্যস্ত টুম্পা অতি দ্রুত শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কথা যেটুকু বলেছিলো আমায়,
" শ্রীকৃষ্ণের মামার নাম ছিলো কংস। কংস ছিল পরাক্রমশালী এবং অত্যাচারী রাজা, তার অত্যাচারে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ ছিলো।
সে শুধুই অত্যাচারী ছিলো না, কংস ভগবান মানতো না। বাবা, মা, ভাই, বোন কাউকে ভালোবাসতো না।
নিজের বাবাকে সে কারাগারে বন্দী করে রেখেছিল। কংসের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতেও পারতো না।
তেমন সময়ে একদিন কংস দৈববাণী শুনলো যে, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানই তাকে বধ করবে।
এটা শোনার পরেই কংস দেবকী আর তার স্বামী বসুদেবকে দীর্ঘ কালের জন্য কারাগারে বন্দী করে রাখে। প্রহরীদের দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁদের উপর কড়া নজর রাখার। কোনোভাবেই যেনো দেবকীর সন্তান জীবিত না থাকে।
কারাগারে থাকা অবস্থায় দেবকী সন্তানসম্ভবা হয়, কংসের নজরদারি বাড়ে। দেবকী সন্তান প্রসব করে, কংস সেই বাচ্চাকে আছাড় দিয়ে হত্যা করে।
এভাবে যখন দেবকী অষ্টমবার সন্তান সম্ভবা হলো, তখন পাহারা ভীষণভাবে জোরদার করা হলো।
এদিকে কারাগারের ভেতর বসুদেব আর দেবকী দৈববাণী শুনলো, তাঁদের ভয় নেই, এবারের সন্তানকে কংস মারতে পারবে না।
যে রাতে তাঁদের অষ্টম সন্তান ( শ্রীকৃষ্ণ) জন্মাবেন সেই রাতে ভীষণ ঝড়-জল, জলোচ্ছ্বাস হবে। ঝড়ের রাতে পাহারাদারেরা সবাই ঘুমে ঢলে পড়বে।
ঝড়ের তান্ডবেই কারাগারের ফটক খুলে যাবে।
ঠিক তখন দেবকী সন্তান প্রসব করবে এবং সন্তান প্রসব হওয়া মাত্র বসুদেব যেন নবজাতককে নিয়ে ফটকের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সামনেই নদী পড়বে, বসুদেব নবজাতককে নিয়ে নদী পার হয়ে যেনো গোকূলে পৌঁছে যায়।
গোকূলে গোয়ালা নন্দলাল আর তার স্ত্রী যশোদার কুঁড়ে-ঘরে তাঁকে পৌঁছাতে হবে।
যশোদাও সন্তান সম্ভবা এবং সেদিনই যশোদা একটি কন্যাসন্তান প্রসব করে অচৈতন্য হয়ে থাকবে।
বসুদেব যেনো তার নবজাতককে অচৈতন্য যশোদার কোলের পাশে শুইয়ে দিয়ে , যশোদার কন্যাটিকে কোলে নিয়ে আবার কারাগারে ফিরে আসে।
দৈববাণী অনুসারেই সব কাজ হচ্ছিলো। ঝড়ের রাতে কারাগারের প্রহরীরা নিজেদের ঘরে দোর বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো। দেবকী অষ্টমবার সন্তান প্রসব করলেন। ঝড়ের দাপটে কারাগারের ফটক খুলে গেলো।
নবজাতককে একটি বেতের ঝুড়িতে শুইয়ে বসুদেব কারাগার থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলেন।
নদী দুই ভাগ হলো, বসুদেব নদীতে নামতেই নদীতে শায়িত বাসুকী নাগ ফণা তুলে বসুদেবের উপর ছাতা মেলে দিল।
বসুদেব শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন গোকূলে গোয়ালা নন্দলালের গোয়ালে। ততক্ষণে যশোদা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বাচ্চা অদল বদল হয়ে গেলো, নিজের শিশুপুত্রকে যশোদার কাছে রেখে যশোদার কন্যা শিশুকে নিয়ে বসুদেব চলে এলো কারাগারে।
সকাল হতেই কংস দেবকীর কন্যা সন্তান জন্মানোর সংবাদ পেলো। এবং যথারীতি কারাগারে এসে কংস সেই শিশুকন্যাকে আছাড় দিলো।
কিন্তু কন্যা মাটিতে পড়লো না, কারাগারের দেয়ালে আটকে গেলো। এবং হাসতে হাসতে বললো,
“ওহে মূর্খ" তোমাকে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে” বলেই শূন্যে মিলিয়ে গেলো।“
** এবং পরবর্তীতে যশোদার কোলে বড়ো হওয়া ভাগ্নে শ্রীকৃষ্ণের হাতেই অত্যাচারী মামা কংস বধ হন।**
** মূলকথাঃ অনাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, লাগামহীন দুর্নীতি, সীমাহীন অত্যাচার যখন সমাজ সংসার বিধ্বস্ত করে তোলে, তখনই ঈশ্বর জাগ্রত হন। নিজে আবির্ভুত হয়ে শিষ্টের প্রতিপালন করার জন্য দুষ্টের দমন করেন।**
আমি খুব বেশি ধর্মকথা জানি না, কিন্তু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো সম্পর্কে জানি। কোন্ পূজোয় কী খাওয়া দাওয়া হয়, তার খবর রাখি। খাবার দাবারের প্রতি আমার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে।
জন্মাষ্টমী তিথিতে অধিকাংশ হিন্দু বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণের পূজো হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, শ্রীকৃষ্ণ মাখন ক্ষীর পায়েস খেতে ভালোবাসে। যশোদা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নন্দগোপাল ( শ্রীকৃষ্ণ) মাখন চুরী করে খেতো। তাই কৃষ্ণকে আদর করে ভক্তরা ' ননীচোরা' ডাকে।
এইজন্যই জন্মাষ্টমীর পূজোতে মালপোয়া তালের বড়া ক্ষীর পুলি পায়েস রেঁধে ভোগ নিবেদন করা হয়।
আমি পূজো টুজো না করলেও এতোকাল জন্মাষ্টমীর দিন মালপোয়া ভাজতাম আর মনের সুখে খেতাম।
কিন্তু এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শ্রীকৃষ্ণের পূজো করবো। আমার মতো বক ধার্মিকের হঠাৎ ধার্মিক হতে চাওয়ার পেছনে ছোট্টো একটা গল্প আছে। গল্পটা বলেই ফেলিঃ
আমার দিদিমা দুরন্ত স্বভাবের নারী ছিলেন, ঘরে বসে বারো মাসে তের পার্বণ করার মানুষ উনি ছিলেন না। দিদিমার চার কন্যার মধ্যে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় কন্যাও মায়ের ধারা পেয়েছে।
কিন্তু চতুর্থ অর্থাৎ ছোটো কন্যাটি (আমার ছোটো মাসি) দিনে দিনে বড্ড বেশি ধার্মিক হয়ে গেছে। বারো মাসে তের পার্বণ নয়, তের দু'গুনে ছাব্বিশ পার্বণ পালন করেন।
পূজো করার আগে সারাদিন উপবাস করে পেটের ভেতর থাকা নাড়িভুঁড়িকে তালা বন্ধ করে রাখেন।
ছোটো মাসির সাথে আমার সখ্যতা কিঞ্চিৎ বেশি। তাই আপদে বিপদে, সমস্যায় পড়লে মাসিকে ফোন করি। মাসি বিভিন্ন পূজার কথা বলেন, কে কবে কোন্ পূজা করে সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে তার গল্প শোনান। কিন্তু সরাসরি আমাকে পূজা করতে বলেন না। মাসি জানে, আমি অত ধার্মিক না।
তবে বয়স হচ্ছে তো, মন আগের মতো শক্ত সমর্থ নয়। বিপদে আপদে আজকাল মন দুর্বল হয়, তখন আমি পরম করুণাময়ের শরণ নেই।
মাসিকে মাঝে মাঝে পূজার নিয়মাবলি, আচার বিচার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। যে পূজার নিয়ম কিছু সহজ, জল খেয়ে শরবত খেয়েও উপবাস করা যায়, আমি সেই পূজা করি।
আমার মেসো বর্তমানে অসুস্থ, কিছু দিন আগে মেসোর দেহে অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন চিকিৎসাধীন আছেন, রিকভারি পিরিয়ড চলছে।
তাই প্রায় প্রতিদিন মাসিকে ফোন করি, নানা বিষয়ে কথা বলি। বলাই বাহুল্য, মেসোর কল্যাণ কামনায় মাসি এখন প্রতিদিন কোনো না কোনো দেব দেবীর পূজা ব্রত উপবাস করে চলেছেন।
আজ সকালে মাসিকে ফোন করেছিলাম। জানা দরকার ছিলো, জন্মাষ্টমীতে মালপোয়া ছাড়া আর কি বানানো যায়! আমার মাথায় তো মালপোয়া তালের বড়া ঘুরছে।
মাসি বললো যে, আমার যা মন চায় আমি তাই বানাতে পারি। মাসি নাকি মালপোয়া লুচি হালুয়া আরও কত কি মিষ্ট দ্রব্য তৈরি করে কৃষ্ণ ঠাকুরের সামনে ভোগ নিবেদন করবে।
আমি বললাম, তুমি জন্মাষ্টমীর পূজা দিবে? কী বলো! উপোস করবে তুমি?
মাসি সব প্রশ্নের উত্তরে ' হ্যাঁ' তো বললোই, সাথে আরও সদস্যের নাম যোগ করলো। মাসির সাথে মাসির মেয়ে, মাসির ডাক্তারি পাশ করা ছেলে, মাসির দেওরের ডাক্তারি পড়ুয়া ছেলেও উপোস করে পূজো দিবে।
ফোন করেছিলাম কী জানতে, আর কি জানলাম! আমার মাথা থেকে মালপোয়া তালের বড়া চলে গেলো। মাথায় নতুন চিন্তা, সব পুণ্য মাসি করে ফেললে আমার পুণ্য হবে কেমনে!
ফোন রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও পূজা করবো। মাসি যদি মাসির মেয়ে ছেলে দেওরের ছেলেকে সাথে নিয়ে গণ উপবাস করতে পারে, আমি কি ফেলনা নাকি!
যা জীবনে কল্পনাও করিনি, যা কল্পনাতেও ছিলো না, সেটাই করলাম।
ছুটির দিন, আমার নাস্তিক মনা উত্তম স্বামী ঘরেই ছিলো। গিয়ে বললাম, কাল জন্মাষ্টমী। প্রতি বছর তো কৃষ্ণের পূজা না করেই মালপোয়া ভেজে খাওয়াই তোমাকে। এই বছর আমি কৃষ্ণের পূজা করতে চাই।
উত্তমের কাছে এটা নতুন কোনো গল্প নয়। সে আমাকে ইদানিং এই পূজা সেই পূজা করতে দেখে। সে বললো, বেশ তো, করো।
বললাম, জানো, মাসিকে ফোন করে জানলাম, মাসি আর তার আন্ডা বাচ্চা সবাই গণ উপবাস করে পূজা দিবে।
আমি তো সবসময় একা একা পূজা করি, তাই হয়তো পুণ্য ফল অর্ধেক পাই। আমাদের তিন মেয়ের কল্যাণের কথা ভেবে তুমি কি এবার পূজায় আমার সাথে যুক্ত হবে?
আমার উত্তম হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমার কথার মানে বুঝতে পারছে না! এমনিতে সে নিজে পূজা পার্বণ নিয়ে মাথা না ঘামালেও অন্যের ঈশ্বর ভক্তি নিয়ে কখনো ট্রল করে না। আমিও কখনোই ঈশ্বর ভক্তির ব্যাপারটা কারো উপর চাপিয়ে দেই না।
আমি আমাদের তিন কন্যার কল্যাণের ঊদ্দেশ্যে বাবা মা দুজনে মিলে পূজা করতে চাইছি! উত্তম বোধ হয় বুঝতে পারছে না, কী করবে!
আমিই বললাম, তেমন কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু উপোস করে থাকবে। পূজোর আয়োজন যা কিছু আমিই করবো। তিন মেয়ের কল্যাণে পূজোটা করতে চাইছি, তাই মা বাবা দুজনে মিলে পূজোটা করলে পূজো পূর্ণতা পাবে।
উত্তম বললো, আগামীকাল তো আমার দুপুর পর্যন্ত ক্লাস চলবে!
বুঝলাম, তার পক্ষে দিন মান না খেয়ে বক্তৃতা বকবক করা কঠিন। পেটে ছুঁচো ডন তো মারবেই, বক্তৃতা দিতে গিয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।
তাকে আশ্বস্ত করলাম, তোমার উপোস কঠিন উপোস নয়। জল শরবত চা কফি খেয়ো, সলিড কিছু খেয়ো না।
তিন কন্যার জন্য যদি উত্তমকে আকাশের চাঁদ পেড়ে আনতে হয়, সে আকাশের দিকে হাত বাড়াবেই, প্রাণপণ চেষ্টা করবে চাঁদটাকে ধরার জন্য। আর এটা তো একটা দিন উপোস থাকা।
উত্তম রাজী হয়ে গেলো।
কাল উপোস থাকবে তাই আজ মাছ মাংস গ্রিল করে খাওয়ার সাধ হলো তার। বাজারে গেলো, তেলাপিয়া ফিলে আনলো। আমার অনুরোধে পূজোর জন্য ফলমূল, দুধ এনেছে।
খুবই ভালো লেগেছে একটা ব্যাপার, পূজোর সামগ্রীতে ভরা ব্যাগ সে আলগোছে আমার হাতে তুলে দিয়েছে যেনো মাছ মুরগীর ছোঁয়া না লাগে।
বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ই- মেইল এসেছে উত্তমের কাছে, আগামীকাল খুব খারাপ আবহাওয়ার কারণে দিনের অধিকাংশ ক্লাস বাতিল করা হয়েছে। শুধু সকালের ক্লাসটা করিয়েই উত্তম বাড়ি চলে আসতে পারবে। জন্মাষ্টমীর উপোস থেকে সারাদিন ক্লাসে বকর বকর করে গলা শুকোতে হবে না!
আমি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে উত্তমের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা। শুভ জন্মাষ্টমী 🙏
ছবিঃ Shashwatee Biplob -এর ননীচোরা পুত্র।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন