এভাবেও মানুষ বাঁচে!

আজ ব্যাটারি চালিত ছোটো একটা হুইল চেয়ারে চড়ে এক কাস্টমার প্রিপেইড ফোন কিনতে এসেছে।

কাছাকাছি আসার পর খেয়াল করলাম কাস্টমারের পা নেই, দুটো পা-ই প্রায় গোড়া থেকে কাটা। পা হীন দেহের হিপের মাপ অনুযায়ী হুইল চেয়ারের সীট। 

ফলে কাস্টমারের দেহ চেয়ারের সীটে একেবারে খাপে খাপে বসে গেছে। ভদ্রলোকের পরনে ছিল মরাটে শ্যাওলা রঙের ফুল স্লিভ গেঞ্জি, আর ছাই রঙের শর্টস।

ভদ্রলোক কৃষ্ণাঙ্গ, স্বাস্থ্য ভালো, হাত দুটো পুষ্ট, কোমড় থেকে দুই থাইয়ের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, ছাই রঙের শর্টসে ঢাকা হলেও তা চেয়ারের সীটে বেশ যুতসইভাবে এঁটে আছে।

মানুষটা ফোন কিনলো, মিনিট কার্ড কিনলো। দাম দেয়ার সময় খেয়াল করলাম, তার বাম হাতের পাতা অচল। টাকা পয়সার ছোটো থলেটা চেয়ারের সীটে দুই থাইয়ের চিপায় আগেই রাখা ছিলো বোধ হয়। 

বাম হাতের অচল পাতা দিয়ে টাকার থলেটা আটকে রেখেছে যেন ফ্লোরে পড়ে না যায়। ডান হাতের আঙুল ব্যবহার করে টাকা গুনে আমাকে দিলো।

টাকা পয়সার লেনদেন শেষ করে ফোন আর মিনিট কার্ড ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলাম। ফেরত পয়সা আর রিসিট আলাদা দিলাম। ভদ্রলোক ফেরত পয়সা চেয়ারের সীটে তার দুই থাইয়ের চিপায় রাখলো, আর রিসিটটা ফোনের ব্যাগে ঢুকানোর চেষ্টা করছিলো।

এতক্ষণ আমি এই দুই পা বিহীন প্রায় চলৎশক্তিহীন কাস্টমারের সাথে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করছিলাম যা অন্য সুস্থ সবল সচল কাস্টমারের সাথে করে থাকি। যাতে আমার ব্যবহারে হুইল চেয়ারে অর্ধেক শরীর নির্ভর করে বাঁচা মানুষটির মনের কোথাও অপমান বোধ জন্ম না নেয়, কোনোভাবেই তার ইগো হার্ট না হয়।

ওয়ালমার্ট থেকে বের হওয়ার সময় রিসিট দেখাতে হয় বলেই ভদ্রলোক রিসিটটা চেয়ারের সীটে দুই থাইয়ের চিপায় না ঢুকিয়ে ফোন ব্যাগের ভেতর ঢুকাতে চেষ্টা করছিলো।

একটু ঝামেলা হচ্ছিলো দেখে আমিই ভদ্রলোকের হাত থেকে রিসিট নিয়ে ব্যাগের গায়ে স্টেপল করে ব্যাগটা সযত্নে ভদ্রলোকের ডান হাতে তুলে দিলাম।

আমার এই সহযোগিতাটুকু অর্ধেক শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষটির ইগোতে হার্ট করেনি, বরং এটুকু সহযোগিতা কাস্টমার হিসেবে তার প্রাপ্য বলেই কৃতজ্ঞচিত্তে তা গ্রহণ করেছে। আমাকে হাসিমুখে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন।

অর্ধেক শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষটি হুইল চেয়ারের মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো। মানুষটির চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। 

ঈশ্বর আমাদের কতো দিয়েছেন। দুটি সচল হাত, দুটি সচল পা, দুটি সুস্থ চোখ, দুটি সুস্থ কান, কথা বলার ক্ষমতা!

এতো কিছু পেয়েও আমরা " নাই নাই" করি, " হায় হায়" করি, " আরও চাই" বলে অসম প্রতিযোগিতায় নেমে যেটুকু ছিলো তার সবটুকু খুইয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করি, ঈশ্বরকে দোষারোপ করি!

কখনও আমাদের আশেপাশে থাকা অন্ধ বধির মূক অঙ্গহীন বোধবুদ্ধিহীন মানুষগুলোর দিকে চোখ মেলে তাকাই না, তাই বুঝতেই পারি না কী অমূল্য সম্পদ আমাদের দেহে মজুত আছে যার সঠিক ব্যবহার করলে জীবনে বেঁচে থাকাটুকু অর্থবহ মনে হবে৷ প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচতে ভালো লাগবে।

জীবনে শুধু চাওয়া নয়, না চেয়েই কত কিছু পেয়েছি তার হিসেব খুব কম মানুষেই করে। এভাবেই সোনা মাটিতে থুইয়ে শূন্য আঁচলে গিঁট দিয়ে একদিন জীবনের পাট চুকিয়ে দুই চোখ চিরতরে বন্ধ করি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন