
শুক্রবার (২ মে) আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF) ২০২৫ সালের সূচক প্রকাশ করে। এতে ৩৩.৭১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৪৯তম অবস্থানে উঠে এসেছে। অথচ ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম, ২০২৩ সালে ছিল ১৬৩তম।
দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এবার পিছনে ফেলেছে ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানকে। তবে নেপাল (৯০তম), শ্রীলঙ্কা (১৩৯তম) ও মালদ্বীপ (১০৪তম) এখনও অনেক এগিয়ে। টানা নবমবারের মতো সূচকের শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে এস্তোনিয়া ও নেদারল্যান্ডস।
RSF-এর রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের অর্ধেক দেশে সাংবাদিকতার পরিবেশ বর্তমানে ‘খারাপ’ এবং এক-চতুর্থাংশেরও কম দেশে ‘সন্তোষজনক’। যুক্তরাষ্ট্রও এ তালিকায় ৫৭তম অবস্থানে নেমে এসেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিয়েরা লিওনের নিচে। সংস্থাটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদকালকে যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমের অবনতির কারণ হিসেবে দায়ী করেছে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা কী বলছেন?
সূচকে অগ্রগতির খবর ছাপা হওয়ার দিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাংবাদিকদের থেকে ভিন্নধর্মী প্রতিক্রিয়া এসেছে। তারা বলছেন, এটি আসলে ‘মাঠের চিত্র নয়’। কারণ ৫ আগস্টের পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চলছে।
যা ঘটেছে ৫ আগস্টের পর থেকে:
২৯৬ জন সাংবাদিকের নামে প্রায় ৬০০টি মামলা, অধিকাংশই হত্যা মামলা।
১৮ জন গ্রেফতার, জামিন পেয়েছেন মাত্র ২ জন।
প্রায় ১০০০ জন সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী চাকরিচ্যুত।
১৬৮ জনের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল।
৮৩ জনের প্রেসক্লাব সদস্যপদ বাতিল বা স্থগিত।
৬ জন সাংবাদিক নিহত, অগণিত আহত ও লাঞ্ছিত।
৫০টির বেশি সংবাদমাধ্যমে হামলা ও ভাঙচুর।
বেশিরভাগ মিডিয়া হাউজে রাজনৈতিক দখলদারি প্রতিষ্ঠিত।
বিশেষ করে বিটিভি, নাগরিক টিভি, একাত্তর, ডিবিসি, সময় টিভিসহ বহু চ্যানেল ও দৈনিক থেকে শত শত সাংবাদিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। এমনকি জেলা প্রতিনিধি স্তরেও গণহারে ছাঁটাই চলছে।
জমে উঠেছে মামলা ও ভয়
দেশব্যাপী সাংবাদিকদের নামে দায়ের করা মামলার মধ্যে রয়েছে হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা— এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পর্যন্ত অভিযোগ তোলা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক আত্মগোপনে, কারণ জামিন মেলেনি বা তারা পুনরায় হামলার ভয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারছেন না।
গণমাধ্যম দখলের নতুন ইতিহাস
বাংলাদেশে গণমাধ্যম বন্ধের নজির অতীতে থাকলেও, সাংবাদিকরা বলছেন, ‘পুরো মিডিয়া জগৎকে পরিকল্পিতভাবে দখল করে ফেলা’— এটি নতুন এবং ভয়ানক প্রবণতা। মতাদর্শগত ভিন্নতা কিংবা স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করলেই, সাংবাদিকদের টার্গেট করা হচ্ছে।
‘স্বাধীনতা’ সূচকে অর্জন, বাস্তবে সংকোচন
RSF-এর সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়েছে ঠিকই, তবে মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, চাকরি, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার— এসবের অবস্থা বিপর্যয়ের কিনারায়। সাংবাদিকরা বলছেন, “আমরা হয়তো ভারত-পাকিস্তানের ওপরে আছি কাগজে-কলমে। কিন্তু মাঠে তাদের থেকেও বেশি ভয় নিয়ে কাজ করছি।”
বিশ্লেষকদের মতে, যদি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই অব্যাহত দমন-পীড়ন চলতে থাকে, তাহলে স্বাধীন ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন সুদূরপরাহত হয়ে পড়বে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন