কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান: অস্ত্রের মহড়া থেকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া


ফাহিমা বেগম প্রিয়া, কুমিল্লা : কুমিল্লা শহরের অলিগলি যেন দিন দিন রণক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি শহর ও সদর দক্ষিণ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্র সরবরাহকারী চক্রের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর (সেনাবাহিনী ও র‍্যাব) অভিযানে ৯ জন অপরাধী গ্রেপ্তার হয়। অভিযানের সময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশীয় ও বিদেশি অস্ত্র, মাদক ও অবৈধ সামগ্রী।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন মো. রুবেল (৩৫), যিনি কুমিল্লার কিশোর গ্যাং সদস্যদের কাছে মূল অস্ত্র সরবরাহ করতেন। রাত ৩টা ৫০ মিনিটে তাকে দুর্গাপুর এলাকা থেকে আটক করা হয়। একই অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় আরও আটজন সহযোগীকে, যাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে।

এক দশকের ইতিহাস- ২০১৫ সালের দিকে কুমিল্লা শহরে কিশোর গ্যাংয়ের নাম প্রকাশ্যে আসে। ‘রতন গ্রুপ’ (আসল নাম 'র স্কোয়াড'), 'ঈগল', 'সিবিকে', 'র‍্যাক্স', 'এলআরএন', 'মডার্ন', 'ডিস্কো বয়েজ'সহ প্রায় ২০টিরও বেশি গ্যাংয়ের উপস্থিতি এখন প্রতিষ্ঠিত। এরা নিজেদের এলাকা ও আধিপত্য দেখাতে প্রকাশ্যে মহড়া দেয়, অস্ত্র উঁচিয়ে চলে মিছিল, ফাঁকা গুলি বর্ষণ, এমনকি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও।

গত ৮ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, ইভটিজিং - এসব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

অবস্থান জানান দিতে মহড়া- গত শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে কুমিল্লা নগরের তিনটি এলাকায় দেশীয় অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে মহড়া দেয় কয়েকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। এতে নগরবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, একপর্যায়ে পুলিশের উপস্থিতির আগেই তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।

সাবেক এক গ্যাং সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রতন গ্রুপ বর্তমানে কিছুটা চাপে থাকায় 'সিবিকে' ও 'ঈগল' গ্রুপসহ অন্যরা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য এ মহড়া দিয়েছে। নতুন করে শক্তি দেখানোর চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পেছনের শক্তি: রাজনৈতিক ছত্রছায়া?- গ্যাংগুলোর এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়ার অভিযোগও উঠেছে। সাবেক গ্যাং সদস্যের ভাষ্য, “আগে আওয়ামী লীগের লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতো, এখন বিএনপির কিছু নেতাও জড়িত। তবে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নিজেরা কখনও সামনে আসে না। সবকিছু ঘটে পর্দার আড়ালে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ায় গ্যাংগুলো কঠিনভাবে দমন করা কঠিন হয়ে উঠছে। কিশোরদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য।

উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও সামগ্রী : অভিযানে উদ্ধার করা হয় ৯ এমএম পিস্তল, রিভলভার, ১২ রাউন্ড গুলি, ইয়াবা ট্যাবলেট, বিদেশি মদ, স্বর্ণের চেইন, চারটি মোবাইল ফোন ও একটি ল্যাপটপ। এসব আলামত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে পারিবারিক অবহেলা, শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, নৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রবণতা বড় ভূমিকা রাখছে। এখনই সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ না করলে, এই কিশোর গ্যাং সমস্যাটি ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে — এমন সতর্কতা দিচ্ছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন